গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা কী-
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা হলো এক ধরনের স্নায়বিক ব্যথা, যা মূলত সায়াটিক নার্ভ চাপে এলে ঘটে। এই স্নায়ুটি কোমর থেকে শুরু হয়ে নিতম্ব ও উরুর পেছন দিয়ে পা পর্যন্ত নেমে যায়। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে শিশুর ওজন বৃদ্ধি, জরায়ুর চাপ এবং হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে এই স্নায়ুতে চাপ পড়ে, ফলে সায়াটিকার ব্যথা দেখা দেয়।
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথার কারণ-
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানগুলো হলো:
- শিশুর ওজন বৃদ্ধি – শিশুর বৃদ্ধি পাওয়ায় জরায়ু বড় হয় এবং তা কোমর ও সায়াটিক নার্ভে চাপ সৃষ্টি করে।
- হরমোনাল পরিবর্তন – গর্ভাবস্থায় রিল্যাক্সিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা জয়েন্টগুলো ঢিলে করে দেয়। এতে কোমরে চাপ পড়ে।
- অতিরিক্ত ওজন – গর্ভাবস্থায় ওজন বাড়লে মেরুদণ্ড ও কোমরে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়।
- অবস্থান পরিবর্তন – দাঁড়িয়ে থাকা, বেশি হাঁটা বা দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে স্নায়ু চাপে আসে।
- ডিস্ক সমস্যা – আগে থেকেই ডিস্ক বা মেরুদণ্ডজনিত সমস্যা থাকলে গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ঝুঁকি বাড়ে।
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথার উপসর্গ-
গর্ভবতী মায়েরা সাধারণত নিচের উপসর্গগুলো অনুভব করেন:
- কোমর থেকে নিতম্ব ও পা পর্যন্ত টান ধরা ব্যথা
- এক পায়ে তীব্র ব্যথা বা ঝিনঝিন অনুভূতি
- হাঁটতে বা দাঁড়াতে কষ্ট হওয়া
- পায়ের আঙুল বা পায়ের পাতায় অসাড়ভাব
- দীর্ঘ সময় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যথা বেড়ে যাওয়া
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা কখন বেশি হয়-
- গর্ভের শেষ তিন মাসে শিশুর ওজন বেড়ে গেলে
- হঠাৎ করে ভারি কিছু তুললে
- দীর্ঘ সময় একই ভঙ্গিতে থাকলে
- রাতে ঘুমের সময় শোয়ার ভঙ্গি ঠিক না হলে
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা প্রতিকার-
গর্ভাবস্থায় ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয়, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিকার নির্ভর করে জীবনযাপনের পরিবর্তনের ওপর।
- গরম সেঁক বা ঠান্ডা সেঁক – ব্যথার জায়গায় গরম বা ঠান্ডা সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যায়।
- হালকা ব্যায়াম – হালকা স্ট্রেচিং ব্যায়াম স্নায়ুর চাপ কমায়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করতে হবে।
- ম্যাসাজ – হালকা ম্যাসাজ রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং ব্যথা কমায়।
- শরীর সঠিক ভঙ্গিতে রাখা – বসা, হাঁটা ও শোয়ার সময় ভঙ্গি ঠিক রাখা জরুরি।
- গর্ভবতী মায়েদের জন্য বালিশ ব্যবহার – পাশে কাত হয়ে শোয়া এবং পায়ের মাঝে বালিশ রাখা সায়াটিকার ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথার চিকিৎসা-
যদি ব্যথা সহনীয় না হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। চিকিৎসক সাধারণত নিচের পদক্ষেপ নিতে পারেন:
- নিরাপদ পেইন রিলিভার ওষুধ
- ফিজিওথেরাপি
- প্রেনাটাল যোগ ব্যায়াম
- সাপোর্ট বেল্ট বা ম্যাটারনিটি বেল্ট ব্যবহার
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা প্রতিরোধ-
ব্যথা হওয়ার আগেই কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করে প্রতিরোধ করা যায়:
- নিয়মিত হালকা হাঁটা
- সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও দাঁড়ানো
- ভারি জিনিস না তোলা
- পিঠ সাপোর্ট দেয় এমন চেয়ার ব্যবহার
- সুষম খাদ্য গ্রহণ ও ওজন নিয়ন্ত্রণ
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথায় ঘরোয়া যত্ন-
গর্ভবতী মায়েরা ঘরোয়া কিছু যত্নের মাধ্যমে আরাম পেতে পারেন:
- গরম পানিতে গোসল করা
- হালকা যোগব্যায়াম ও শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
- দীর্ঘ সময় এক জায়গায় না বসা বা না দাঁড়ানো
- সাঁতার কাটা (চিকিৎসকের অনুমতি সাপেক্ষে)
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা কখন ডাক্তার দেখাতে হবে-
- ব্যথা খুব বেশি হলে
- হাঁটতে বা দাঁড়াতে না পারলে
- পা অসাড় হয়ে গেলে
- প্রস্রাব বা মলত্যাগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হলে
এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথার মানসিক প্রভাব-
এই ব্যথা শারীরিক অস্বস্তি ছাড়াও মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে মায়ের ঘুমের সমস্যা, উদ্বেগ ও ক্লান্তি বেড়ে যায়। তাই পরিবার ও কাছের মানুষদের সহযোগিতা খুব জরুরি।
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা অনেক মায়ের জন্যই সাধারণ একটি সমস্যা। যদিও এটি বেশ অস্বস্তিকর, তবে সঠিক যত্ন, জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং চিকিৎসকের পরামর্শে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মায়ের সুস্থতা শিশুর সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি, তাই ব্যথা উপেক্ষা না করে সময়মতো প্রতিকার করা প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা সম্পর্কিত প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, অনেক মায়ের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। তবে যদি ব্যথা সহনীয় না হয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথায় কি ওষুধ খাওয়া যায়?
শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে নিরাপদ ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। নিজে থেকে কোনো ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় সায়াটিকার ব্যথা কি শিশুর জন্য ক্ষতিকর?
সরাসরি শিশুর ক্ষতি না হলেও মায়ের অতিরিক্ত অস্বস্তি শিশুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ব্যথা নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
প্রশ্ন ৪: ঘরোয়া উপায়ে কি সায়াটিকার ব্যথা কমানো যায়?
হ্যাঁ, হালকা ব্যায়াম, গরম সেঁক, সঠিক শোয়ার ভঙ্গি ও বিশ্রাম ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ৫: সায়াটিকার ব্যথা কি ডেলিভারির পর চলে যায়?
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেলিভারির পর এই ব্যথা অনেকটাই কমে যায় বা পুরোপুরি সেরে যায়।