আইভিএফ পদ্ধতি: পরিচিতি-
আজকের যুগে বন্ধ্যাত্ব বা সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক দম্পতি বহু বছর চেষ্টা করার পরও প্রাকৃতিকভাবে সন্তান ধারণে ব্যর্থ হন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এই সমস্যার সমাধান হিসেবে আইভিএফ পদ্ধতি বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন নিয়ে এসেছে। এটি বর্তমানে সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কার্যকরী একটি চিকিৎসা পদ্ধতি।
আইভিএফ পদ্ধতি কী? সংজ্ঞা-
আইভিএফ পদ্ধতি হলো এমন একটি প্রজনন চিকিৎসা যেখানে নারীর ডিম্বাণু এবং পুরুষের শুক্রাণু শরীরের বাইরে ল্যাবরেটরিতে মিলিত করা হয়। পরে নিষিক্ত ভ্রূণকে নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এভাবে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আইভিএফ পদ্ধতির ইতিহাস-
- ১৯৭৮ সালে বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি “লুইস ব্রাউন” জন্মগ্রহণ করে ইংল্যান্ডে।
-
এই পদ্ধতির বিকাশের জন্য ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট এডওয়ার্ডস ২০১০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
- তারপর থেকে এই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
- বর্তমানে বাংলাদেশসহ বহু দেশে আইভিএফ চিকিৎসা সফলভাবে চলছে।
কারা আইভিএফ পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত?-
১. দীর্ঘদিন ধরে সন্তান না হওয়ার সমস্যা থাকলে
২. নারীর ফলোপিয়ান টিউব ব্লক হয়ে গেলে
৩. ডিম্বাণু উৎপাদনে সমস্যা হলে
৪. পুরুষের শুক্রাণুর গুণগত সমস্যা থাকলে
৫. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS) এর কারণে সন্তান ধারণ না হলে
৬. বয়স বেশি হয়ে গেলে
আইভিএফ পদ্ধতি কিভাবে করা হয়?-
আইভিএফ চিকিৎসা কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়—
১. ডিম্বাণু উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ
নারীর শরীরে হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে একাধিক ডিম্বাণু তৈরি করা হয়।
২. ডিম্বাণু সংগ্রহ (Egg Retrieval)
ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়।
৩. শুক্রাণু সংগ্রহ
পুরুষের কাছ থেকে শুক্রাণু নেওয়া হয়।
৪. নিষিক্তকরণ (Fertilization)
ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে ল্যাবরেটরিতে মিলিয়ে ভ্রূণ তৈরি করা হয়।
৫. ভ্রূণ প্রতিস্থাপন (Embryo Transfer)
তৈরি হওয়া ভ্রূণকে নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
৬. গর্ভধারণ পরীক্ষা
প্রায় ১০-১৪ দিন পর রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভধারণ নিশ্চিত করা হয়।
আইভিএফ পদ্ধতির সাফল্যের হার-
- নারীর বয়স ৩৫ বছরের নিচে হলে সাফল্যের হার ৪০-৫০% পর্যন্ত হতে পারে।
- বয়স ৪০-এর বেশি হলে সাফল্যের হার কমে ১০-২০% এ নেমে যায়।
- সঠিক সেন্টার, অভিজ্ঞ ডাক্তার ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর সাফল্য নির্ভর করে।
আইভিএফ পদ্ধতির খরচ-
বাংলাদেশে আইভিএফ চিকিৎসার খরচ সাধারণত ২ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে—
- ক্লিনিক বা হাসপাতালের মান
- ওষুধ ও ইনজেকশনের খরচ
- অতিরিক্ত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা
ইত্যাদির ওপর খরচ নির্ভর করে।
আইভিএফ পদ্ধতির সুবিধা-
- প্রাকৃতিকভাবে সন্তান ধারণে ব্যর্থ দম্পতিদের জন্য আশা জাগায়।
- জেনেটিক সমস্যা এড়িয়ে সুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব।
- অতিরিক্ত ভ্রূণ সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যায়।
আইভিএফ পদ্ধতির ঝুঁকি-
- একাধিক শিশুর জন্ম (টুইন বা ট্রিপলেট) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- হরমোন ইনজেকশনের কারণে ডিম্বাশয়ে সমস্যা হতে পারে।
- মানসিক চাপ ও হতাশা তৈরি হতে পারে।
- খরচ বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষে বহন করা কঠিন।
আইভিএফ পদ্ধতি ও বাংলাদেশ-
বাংলাদেশে আইভিএফ পদ্ধতি (In Vitro Fertilization) দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এক সময় যেটিকে মানুষ শুধুমাত্র “টেস্টটিউব বেবি” হিসেবে জানতো, এখন সেটিই বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশে আইভিএফ চিকিৎসার সূচনা
বাংলাদেশে আইভিএফ সেন্টার
ঢাকায় বেশ কিছু বিশেষায়িত আইভিএফ ক্লিনিক রয়েছে, যেমন—
-
ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার (ICRC)
-
ইসলামি ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইভিএফ ইউনিট
-
জনপ্রিয় হাসপাতাল আইভিএফ ইউনিট
-
মেডিকেল কলেজ ও কিছু প্রাইভেট হাসপাতালের আইভিএফ বিভাগ
এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটেও ধীরে ধীরে আইভিএফ সেবা বিস্তৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে আইভিএফ পদ্ধতির খরচ
বাংলাদেশে আইভিএফ চিকিৎসার খরচ সাধারণত ২ থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। তবে ক্লিনিকভেদে, ওষুধ ও ইনজেকশনের পরিমাণ এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর খরচ বাড়তে বা কমতে পারে।
সাফল্যের হার
বাংলাদেশে আইভিএফ চিকিৎসার সাফল্যের হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব একটা কম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে—
-
নারীর বয়স ৩৫ বছরের নিচে হলে সাফল্যের হার ৩৫-৪৫%।
-
বয়স বেশি হলে সাফল্যের হার কমে যায়।
-
আধুনিক ল্যাব ও অভিজ্ঞ ডাক্তার থাকায় বাংলাদেশেও এখন অনেক পরিবার সফলভাবে সন্তান লাভ করছে।
চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
-
খরচ অনেকের নাগালের বাইরে।
-
গ্রামীণ অঞ্চলে এই চিকিৎসা এখনও সহজলভ্য নয়।
-
অনেক মানুষ এখনো সামাজিক ট্যাবু ও কুসংস্কারের কারণে আইভিএফ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত।
আইভিএফ পদ্ধতি নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি-
- ধৈর্য ধরে চেষ্টা করা জরুরি।
- সাফল্য সবসময় একবারেই আসে না।
- পরিবার ও স্বামীর মানসিক সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার-
আইভিএফ পদ্ধতি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অনন্য অর্জন। এটি শুধু সন্তান লাভের আশা জাগায় না, বরং হাজারো পরিবারে নতুন আলো ছড়ায়। তবে এর খরচ, ঝুঁকি ও মানসিক চ্যালেঞ্জগুলো আগে থেকেই জেনে নেওয়া জরুরি। সঠিক পরামর্শ, অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও দৃঢ় মানসিকতা থাকলে আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে মা-বাবা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।
সাধারণ প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: আইভিএফ পদ্ধতির সাফল্যের হার কত?
উত্তর: বয়স ও স্বাস্থ্য অনুযায়ী ভিন্ন হয়। সাধারণত ৩৫ বছরের নিচে সাফল্যের হার ৪০-৫০%।
প্রশ্ন: আইভিএফ পদ্ধতির খরচ কত?
উত্তর: বাংলাদেশে গড়ে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
প্রশ্ন: আইভিএফ কি সবার জন্য উপযুক্ত?
উত্তর: না, ডাক্তার রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেন।
প্রশ্ন: আইভিএফ পদ্ধতিতে কি একাধিক সন্তান জন্ম নিতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, টুইন বা ট্রিপলেট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
প্রশ্ন: আইভিএফ চিকিৎসা কতবার করা যায়?
উত্তর: সাধারণত ৩-৪ বার চেষ্টা করা যায়, তবে ডাক্তার পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।