একাধিক সিজারের ঝুঁকি-
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বর্তমানে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান ডেলিভারির হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির কারণে মায়ের ও শিশুর জীবন রক্ষায় সিজার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে একাধিকবার সিজার করানোর ফলে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেকেই মনে করেন প্রথম সিজারের পর দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার সিজার করাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বাস্তবে একাধিক সিজারিয়ানের ঝুঁকি অনেক বড় হতে পারে।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো—একাধিক সিজারিয়ানের ঝুঁকি কী কী, কেন তা মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, ভবিষ্যৎ গর্ভধারণে এর প্রভাব কী, এবং কিভাবে এ ধরনের ঝুঁকি কমানো যায়।
সিজারিয়ান ডেলিভারি: সংক্ষিপ্ত ধারণ-
সিজারিয়ান ডেলিভারি হলো শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে মায়ের পেট ও জরায়ু কেটে শিশুকে বের করার প্রক্রিয়া। সাধারণত যখন স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না বা মায়ের বা শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তখন ডাক্তাররা সিজার করার সিদ্ধান্ত নেন।
তবে নানা কারণে এখন অনেক মা ও পরিবার অপ্রয়োজনে সিজার বেছে নিচ্ছেন। এর ফলে প্রতি বছর একাধিকবার সিজার করার ঘটনা বাড়ছে।
কেন একাধিকবার সিজার করার প্রয়োজন হতে পারে?-
১. প্রথমবার সিজারের পর স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা কমে যায়।
২. জরায়ুর জটিলতা বা পূর্ববর্তী কাটা অংশে দুর্বলতা।
৩. শিশুর অবস্থান সঠিক না হওয়া।
৪. মায়ের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো জটিলতা।
৫. ডাক্তারদের পরামর্শ ও চিকিৎসা প্রটোকল।
একাধিক সিজারের ঝুঁকির প্রভাব-
জরায়ুতে আঘাত বা ছিঁড়ে যাওয়া
প্রতিবার সিজার করার সময় জরায়ুতে কাটা দেওয়া হয়। একাধিকবার কাটাছেঁড়া হলে জরায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যতে গর্ভধারণের সময় ছিঁড়ে যাওয়ার (Uterine Rupture) ঝুঁকি বাড়ে।
অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
বারবার সিজারের ফলে জরায়ু, ব্লাডার (মূত্রথলি) বা অন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রক্তক্ষরণ বেড়ে যাওয়া
প্রতিবার সিজারে রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একাধিক সিজারের ক্ষেত্রে এই রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হতে পারে এবং রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।
প্লাসেন্টার জটিলতা
- Placenta previa (প্লাসেন্টা জরায়ুর নিচের দিকে থাকা)
- Placenta accreta (প্লাসেন্টা জরায়ুর সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে আটকে যাওয়া)
এ ধরনের সমস্যা বারবার সিজার করা মায়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
সংক্রমণের ঝুঁকি
একাধিকবার অপারেশনের কারণে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, বিশেষ করে জরায়ু ও মূত্রনালিতে।
অস্ত্রোপচার দীর্ঘায়িত হওয়া
দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার সিজারের সময় ডাক্তারদের জন্য অপারেশন তুলনামূলক কঠিন হয়ে যায়, কারণ পূর্ববর্তী কাটা অংশে দাগ ও টিস্যু জমে যায়।
দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা ও মানসিক চাপ
বারবার সিজারের পর অনেক মা দীর্ঘমেয়াদী কোমর, পেট বা সার্জিক্যাল এলাকার ব্যথায় ভোগেন। এছাড়া অপারেশনের ভয়, মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতাও দেখা দেয়।
ভবিষ্যৎ গর্ভধারণে একাধিক সিজারের প্রভাব-
- ভবিষ্যতে স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করা কঠিন হতে পারে।
- গর্ভপাত বা ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- গর্ভকালীন জটিলতা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, রক্তক্ষরণ ও ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শিশুর ওপর একাধিক সিজারের প্রভাব-
- শিশুর জন্মের সময় শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
- নবজাতকের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
- বারবার সিজার করার ফলে প্রি-ম্যাচিউর বেবি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
একাধিক সিজারের ঝুঁকি কমানোর উপায়-
১. অপ্রয়োজনীয় সিজার এড়িয়ে চলা।
২. স্বাভাবিক প্রসবের প্রতি উৎসাহিত হওয়া।
৩. গর্ভকালীন নিয়মিত চেকআপ ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা।
৪. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পরবর্তী গর্ভধারণ না করা।
৫. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ব্যায়াম ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা।
মায়ের জন্য পরামর্শ-
- প্রথম সিজারের পর দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের আগে অন্তত ২–৩ বছর বিরতি নেওয়া উচিত।
- অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্টের পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।
- ঝুঁকির বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন করা।
একাধিক সিজারর ঝুঁকি নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা-
- অনেকে মনে করেন সিজার ডেলিভারি একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত।
- কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, যতবার ইচ্ছা সিজার করানো যায়।
- আবার অনেকে মনে করেন, সিজারের পর দ্রুত সুস্থ হয়ে যাওয়া যায়।
আসলে এই ধারণাগুলো ভুল। প্রতিবার সিজার করার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বেড়েই চলে।
উপসংহার-
একাধিক সিজারিয়ানের ঝুঁকি শুধু মায়ের জন্যই নয়, শিশুর জন্যও মারাত্মক হতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে সিজার অনেক সময় জীবনরক্ষাকারী হয়ে ওঠে, তবে অপ্রয়োজনীয় সিজার এড়িয়ে চলা উচিত। একজন সচেতন মা হিসেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, নিয়মিত চেকআপ করা এবং ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
একাধিক সিজারের ঝুঁকি সম্পর্কিত প্রশ্ন-
১. একাধিক সিজার করলে কি পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব?
সাধারণত একাধিক সিজারের পর স্বাভাবিক প্রসব কঠিন হয়ে পড়ে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে সম্ভব হতে পারে।
২. দ্বিতীয় সিজার কত বছর পর করানো নিরাপদ?
প্রথম সিজারের পর অন্তত ২–৩ বছর বিরতি রেখে দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করাই নিরাপদ।
৩. একাধিক সিজারের পর কি গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে?
হ্যাঁ, জরায়ু দুর্বল হয়ে পড়ায় গর্ভপাত বা গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
৪. সিজারের পর কোন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি হয়?
সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ, ব্যথা এবং প্লাসেন্টার জটিলতা বেশি দেখা যায়।
৫. কীভাবে একাধিক সিজারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব?
অপ্রয়োজনীয় সিজার এড়িয়ে চলা, নিয়মিত চেকআপ করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখলে ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব।