এম আর (MR) কী?: ভূমিকা-
বাংলাদেশে “এম আর (MR)” বা Menstrual Regulation শব্দটি অনেকেই শুনেছেন, কিন্তু অনেকে এখনো জানেন না এটি আসলে কী, কখন করা হয়, বা এটি গর্ভপাতের সমান কিনা। এম আর মূলত এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে গর্ভধারণের শুরুর দিকে গর্ভাশয় পরিষ্কার করা হয়, যাতে গর্ভপাত সম্পন্ন হয় বা গর্ভধারণ স্থায়ী না হয়।
এই ব্লগে আমরা জানব — এম আর (MR) কী, কখন করা যায়, কিভাবে করা হয়, এর ঝুঁকি, আইনি দিক, ও এম আর পরবর্তী যত্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। (গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও মানসিক সহায়তা)
এম আর (MR) কী-
এম আর (MR) বা Menstrual Regulation হলো এমন একটি চিকিৎসা প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নারীর মাসিক বন্ধ হওয়ার পর গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার আগেই জরায়ু পরিষ্কার করা হয়। এটি এক ধরনের প্রাথমিক গর্ভপাতের পদ্ধতি যা প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা প্যারামেডিক দ্বারা নিরাপদভাবে সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশে এম আর (MR) একটি আইনগতভাবে স্বীকৃত প্রক্রিয়া, যা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়।
এম আর (MR) ও গর্ভপাতের মধ্যে পার্থক্য-
অনেকে এম আর ও গর্ভপাতকে একই জিনিস মনে করেন, কিন্তু আসলে এদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। এম আর করা হয় গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার আগেই, আর গর্ভপাত করা হয় গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পরে। এম আর সাধারণত বারো সপ্তাহের মধ্যে করা হয়, আর গর্ভপাত হতে পারে বিশ সপ্তাহ পর্যন্ত। এম আর হলো একটি বৈধ পরিবার পরিকল্পনা সেবা, কিন্তু গর্ভপাত কেবল জীবন রক্ষার প্রয়োজনে বৈধ।
এম আর (MR) কখন করা যায়-
বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মাসিক বন্ধ হওয়ার সর্বোচ্চ বারো সপ্তাহের মধ্যে এম আর করা যায়। প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স বা প্যারামেডিক এটি সম্পন্ন করতে পারেন। যত তাড়াতাড়ি এম আর করা যায়, ততই এটি নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত হয়।
ওষুধের মাধ্যমে এম আর করা যায় আট সপ্তাহের মধ্যে, আর সাকশন পদ্ধতিতে বা Manual Vacuum Aspiration (MVA) প্রক্রিয়ায় করা যায় বারো সপ্তাহ পর্যন্ত।
এম আর (MR) করার কারণ-
নারীরা বিভিন্ন কারণে এম আর করাতে পারেন। কেউ কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে, কেউ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ার কারণে, আবার কেউ শারীরিক বা মানসিক প্রস্তুতি না থাকার কারণে এম আর করান। অনেক সময় আর্থিক বা পারিবারিক সমস্যাও এর পেছনে ভূমিকা রাখে। তবে সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ প্রতিটি নারীর পরিস্থিতি আলাদা।
এম আর (MR) করার প্রক্রিয়া-
এম আর সাধারণত দুইভাবে করা হয় — ওষুধের মাধ্যমে এবং সাকশন পদ্ধতিতে।
ওষুধের মাধ্যমে এম আর করা হয় গর্ভধারণের আট সপ্তাহের মধ্যে। প্রথমে মিফিপ্রিস্টোন নামক একটি ওষুধ গ্রহণ করতে হয় যা গর্ভের হরমোনকে ব্লক করে। এরপর মিসোপ্রোস্টল ওষুধ খাওয়ানো হয়, যা জরায়ুতে সংকোচন ঘটিয়ে গর্ভের টিস্যু বের করে দেয়। এই পদ্ধতি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বাড়িতেও সম্পন্ন করা যায়।
সাকশন পদ্ধতি বা Manual Vacuum Aspiration (MVA) করা হয় আট থেকে বারো সপ্তাহের মধ্যে। এতে ভ্যাকুয়াম টিউবের মাধ্যমে জরায়ু থেকে গর্ভের টিস্যু পরিষ্কার করা হয়। এটি সাধারণত দশ থেকে পনের মিনিট সময় নেয় এবং স্থানীয় অ্যানাস্থেসিয়া ব্যবহার করা হয় যাতে ব্যথা কম অনুভূত হয়।
এম আর (MR) করার আগে যা জানা প্রয়োজন-
এম আর করার আগে গর্ভধারণের সময়কাল নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য আলট্রাসাউন্ড করা যেতে পারে। নিজের রক্তের গ্রুপ ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা ভালো। যদি রক্তপাত বা সংক্রমণের সমস্যা থাকে, আগে সেটি চিকিৎসা করানো উচিত। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শারীরিকের পাশাপাশি মানসিক দিক থেকেও একটি সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া নিজে থেকে এম আর করার চেষ্টা করা বিপজ্জনক হতে পারে।
এম আর (MR) করার পর শরীরের পরিবর্তন-
এম আর করার পর কিছু স্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকের হালকা পেট ব্যথা বা ক্র্যাম্প হতে পারে। পাঁচ থেকে সাত দিন পর্যন্ত হালকা রক্তপাত হতে পারে, যা ধীরে ধীরে কমে যায়। কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা অনুভব হতে পারে। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মেজাজে অস্থিরতাও দেখা দিতে পারে। তবে এসব সাধারণত অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
এম আর (MR) করার পর যত্ন-
এম আর করার পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। অন্তত দুই থেকে তিন দিন ভারী কাজ বা শারীরিক পরিশ্রম থেকে বিরতি নিতে হবে। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি, কারণ সংক্রমণ হলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। প্রতিদিন গোসল করা এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা উচিত। অন্তত দুই সপ্তাহ যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা ভালো। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফলো-আপ করতে হবে এবং নতুন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যাতে পুনরায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ না হয়।
এম আর (MR)-এর সম্ভাব্য ঝুঁকি-
এম আর যদি প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের মাধ্যমে নিরাপদ পরিবেশে করা হয়, তবে ঝুঁকি খুবই কম। কিন্তু অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির মাধ্যমে বা অপরিচ্ছন্ন স্থানে করলে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত রক্তপাত, সংক্রমণ, জরায়ুর ক্ষতি, অপূর্ণ এম আর বা ভবিষ্যতে গর্ভধারণে জটিলতা — এসব ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই কখনোই গোপনে বা অবৈধভাবে এম আর করানো উচিত নয়।
এম আর (MR)-এর আইনি অবস্থান-
বাংলাদেশে এম আর একটি বৈধ পরিবার পরিকল্পনা সেবা, যা ১৯৭৯ সাল থেকে সরকারিভাবে চালু হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও প্যারামেডিকরা এটি সম্পন্ন করেন। তবে এম আর শুধুমাত্র বারো সপ্তাহের মধ্যে করা যায়। এর বেশি সময় হলে এটি গর্ভপাতের আওতায় পড়ে, যা বাংলাদেশে শুধুমাত্র জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে বৈধ।
এম আর (MR) সেবা কোথায় পাওয়া যায়-
বাংলাদেশে এম আর সেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন যেমন ব্র্যাক, মেরি স্টোপস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে। এসব কেন্দ্রে নারীর গোপনীয়তা রক্ষা করে নিরাপদ পরিবেশে এম আর করা যায়।
এম আর (MR) করার পর গর্ভধারণের সম্ভাবনা-
এম আর করার পর বেশিরভাগ নারীর প্রজনন ক্ষমতা অক্ষত থাকে। শরীর সুস্থ হয়ে গেলে আবার গর্ভধারণ সম্ভব। তবে তিন মাসের বিরতি নেওয়া ভালো যাতে জরায়ু সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার হয়। পুনরায় গর্ভধারণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উপসংহার-
এম আর (MR) বা Menstrual Regulation হলো নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি এমন একটি বৈধ ও নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি যা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ প্রতিরোধে সহায়ক। তবে এটি অবশ্যই প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের মাধ্যমে ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে সম্পন্ন করতে হবে।
নিজের শরীর নিয়ে সচেতন থাকা, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং মানসিকভাবে দৃঢ় থাকা প্রতিটি নারীর অধিকার। এম আর সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে এটি শুধু নিরাপদ নয়, বরং ভবিষ্যতের গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও কোনো ক্ষতি করে না।
প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী-
প্রশ্ন: এম আর (MR) কী?
উত্তর: এম আর বা Menstrual Regulation হলো গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার আগেই জরায়ু পরিষ্কার করার একটি নিরাপদ চিকিৎসা প্রক্রিয়া, যা প্রাথমিক গর্ভপাতের অংশ হিসেবে বিবেচিত।
প্রশ্ন: এম আর (MR) কত সপ্তাহের মধ্যে করা যায়?
উত্তর: ওষুধের মাধ্যমে আট সপ্তাহ পর্যন্ত এবং সাকশন পদ্ধতিতে বারো সপ্তাহ পর্যন্ত এম আর করা যায়।
প্রশ্ন: এম আর (MR) কি নিরাপদ?
উত্তর: প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের মাধ্যমে করা হলে এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তবে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে করলে প্রাণঘাতী হতে পারে।
প্রশ্ন: এম আর (MR) করার পর রক্তপাত কতদিন থাকে?
উত্তর: সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন হালকা রক্তপাত থাকে, তবে দশ দিনের বেশি হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।
প্রশ্ন: এম আর (MR) করার পর আবার গর্ভধারণ করা সম্ভব কি?
উত্তর: হ্যাঁ, অধিকাংশ নারীই পরবর্তীতে সফলভাবে গর্ভধারণ করতে পারেন যদি এম আর প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
প্রশ্ন: এম আর (MR) ও গর্ভপাত কি একই জিনিস?
উত্তর: না, এম আর করা হয় গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার আগেই, আর গর্ভপাত করা হয় গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়ার পরে।