কম ওজনের বাচ্চার যত্ন

কম ওজনের বাচ্চার যত্ন: সঠিক খাবার, পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য টিপস

কম ওজনের বাচ্চার যত্ন: সঠিক খাবার, পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য টিপস-

একটি শিশুর জন্মের পর তার ওজন তার সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। অনেক সময় দেখা যায়, শিশুর জন্মের সময় বা পরে তার ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। এ ধরনের শিশুদের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। কারণ কম ওজনের শিশু সংক্রমণ, পুষ্টিহীনতা ও শারীরিক দুর্বলতায় সহজে ভুগতে পারে।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব কম ওজনের বাচ্চার যত্ন, তাদের সঠিক খাবার, পরিচর্যা, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিয়ে। (মা ও শিশুর যত্ন: সুস্থ জীবনের জন্য করণীয় ও পরামর্শ)

কম ওজনের শিশু বলতে কী বোঝায়?-

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত ২.৫ কেজির নিচে ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুকে কম ওজনের শিশু বা Low Birth Weight Baby বলা হয়। এছাড়াও জন্মের পরে যদি শিশুর ওজন বয়স অনুযায়ী না বাড়ে, তবে তাকেও কম ওজনের শিশুর তালিকায় ধরা হয়।

কেন শিশু কম ওজনের হয়?-

কম ওজনের শিশু হওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন:

  • মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা – গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ।
  • অপর্যাপ্ত পুষ্টি – মা গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে শিশুর ওজন কম হতে পারে।
  • প্রি-ম্যাচিউর জন্ম – নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর ওজন সাধারণত কম হয়।
  • জেনেটিক কারণ – পারিবারিক কারণে কিছু শিশুর জন্মের সময় ওজন কম হতে পারে।
  • ধূমপান ও মাদকাসক্তি – মায়ের খারাপ অভ্যাস শিশুর জন্মের সময় ওজন কমিয়ে দেয়।
  • সংক্রমণ বা রোগ – গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ হলে শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

কম ওজনের বাচ্চার যত্ন কেন জরুরি?-

কম ওজনের শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়। এরা সহজে ঠান্ডা, কাশি, জ্বর বা অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া মস্তিষ্কের বিকাশ, হাড়ের বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক শারীরিক গঠনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই শুরু থেকেই কম ওজনের বাচ্চার যত্ন সঠিকভাবে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

কম ওজনের বাচ্চার যত্নের সঠিক উপায়-

১. বুকের দুধ খাওয়ানো

  • মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার।
  • এটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • কম ওজনের শিশুকে প্রয়োজন অনুযায়ী বারবার দুধ খাওয়াতে হবে।

২. শিশুকে উষ্ণ রাখা

  • কম ওজনের শিশু সহজেই ঠান্ডা লেগে যায়।
  • সবসময় উষ্ণ পোশাক, কম্বল এবং প্রয়োজনে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতিতে মা ও শিশুকে একসাথে উষ্ণ রাখা উচিত।

৩. সঠিক ঘুম নিশ্চিত করা

  • শিশুর সুস্থ বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।
  • শিশুকে নরম ও পরিষ্কার বিছানায় শোয়াতে হবে।

৪. সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা

  • কম ওজনের শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি।
  • হাত ধুয়ে শিশুকে ধরতে হবে।
  • ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।

৫. নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ

  • শিশুর ওজন ও স্বাস্থ্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • টিকাগুলো সময়মতো দিতে হবে।
  • প্রয়োজনে চিকিৎসকের নির্দেশে সাপ্লিমেন্ট দেওয়া যেতে পারে।

কম ওজনের শিশুর খাবার-

জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত

  • একমাত্র বুকের দুধ।
  • কোনো পানি বা অন্য খাবারের প্রয়োজন নেই।

৬ মাস থেকে ১২ মাস

  • বুকের দুধের পাশাপাশি পায়েস, সুজি, ডিমের কুসুম, শাকসবজির পিউরি।
  • সেদ্ধ আলু বা ভাত চটকে খাওয়ানো।

১ বছর পর

  • ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফলমূল।
  • শিশুর জন্য আলাদা করে তেল-ঘি দিয়ে নরম খাবার প্রস্তুত করা।

এই সময় শিশুর খাবারে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকা জরুরি।

কম ওজনের শিশুর যত্নে করণীয়-

  • শিশুকে নিয়মিত ওজন করা।
  • খাওয়ানোর রুটিন তৈরি করা।
  • সঠিকভাবে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শেখা।
  • শিশুর বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা।
  • পর্যাপ্ত ভালোবাসা ও মানসিক যত্ন দেওয়া।

কম ওজনের শিশুর যত্নে যা এড়ানো উচিত-

  • শিশুকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানো।
  • অপরিষ্কার পরিবেশে রাখা।
  • অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরমে রাখা।
  • বাজারজাত কেমিক্যালযুক্ত খাবার খাওয়ানো।

চিকিৎসকদের পরামর্শ-

শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, কম ওজনের শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে।

  • বুকের দুধ সবচেয়ে কার্যকর।
  • নিয়মিত ওজন বাড়ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • শিশুর ওজন না বাড়লে বা হঠাৎ কমে গেলে দেরি না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

ঘরোয়া টিপস-

  • শিশুকে নিয়মিত ত্বকের মালিশ করা।
  • প্রয়োজনে অলিভ অয়েল বা নারকেল তেল ব্যবহার করা।
  • উষ্ণ পরিবেশে শিশুকে রাখা।
  • প্রতিদিন শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।

বয়স অনুযায়ী শিশুর গড় ওজন ও উচ্চতা (Child Growth Chart)-

বয়স (মাস/বছর)গড় ওজন (ছেলে শিশু)গড় ওজন (মেয়ে শিশু)গড় উচ্চতা (ছেলে শিশু)গড় উচ্চতা (মেয়ে শিশু)
জন্মের সময়৩.৩ কেজি৩.২ কেজি৫০ সেমি৪৯ সেমি
১ মাস৪.৫ কেজি৪.২ কেজি৫৪ সেমি৫৩ সেমি
৩ মাস৬.০ কেজি৫.৪ কেজি৬১ সেমি৬০ সেমি
৬ মাস৭.৯ কেজি৭.৩ কেজি৬৮ সেমি৬৭ সেমি
৯ মাস৯.২ কেজি৮.৬ কেজি৭২ সেমি৭০ সেমি
১২ মাস (১ বছর)১০.০ কেজি৯.৫ কেজি৭৬ সেমি৭৫ সেমি
১৮ মাস১১.৫ কেজি১০.৯ কেজি৮২ সেমি৮১ সেমি
২ বছর১২.৫ কেজি১১.৮ কেজি৮৭ সেমি৮৬ সেমি
৩ বছর১৪.৫ কেজি১৩.৯ কেজি৯৫ সেমি৯৪ সেমি
৪ বছর১৬.৩ কেজি১৫.৪ কেজি১০২ সেমি১০১ সেমি
৫ বছর১৮.৪ কেজি১৭.৪ কেজি১০৯ সেমি১০৮ সেমি

উপসংহার-

কম ওজনের বাচ্চার যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকেই সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, উষ্ণ পরিবেশে রাখা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খাওয়ানোই হলো শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার মূল রহস্য।

অভিভাবকদের উচিত শিশুর প্রতি ধৈর্যশীল থাকা, কারণ নিয়মিত যত্ন ও ভালোবাসার মাধ্যমেই শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।

 কম ওজনের বাচ্চার যত্ন নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: কম ওজনের শিশুকে কতবার খাওয়ানো উচিত?
কম ওজনের শিশুকে বারবার খাওয়ানো উচিত, কারণ তাদের শক্তি দ্রুত খরচ হয়। দিনে অন্তত ৮-১০ বার বুকের দুধ খাওয়ানো ভালো।

প্রশ্ন ২: কম ওজনের শিশুর জন্য দুধের পাশাপাশি সাপ্লিমেন্ট দরকার কি?
শিশুর স্বাস্থ্য ও ওজন বৃদ্ধির পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসক সাপ্লিমেন্ট দিতে পারেন। নিজে থেকে কিছু দেওয়া উচিত নয়।

প্রশ্ন ৩: কম ওজনের শিশু কি পরে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে?
হ্যাঁ, সঠিক খাবার, যত্ন ও পরিচর্যা পেলে কম ওজনের শিশুও সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে।

প্রশ্ন ৪: কম ওজনের শিশুর জন্য কোন খাবার সবচেয়ে ভালো?
প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ, এরপর পায়েস, ডিমের কুসুম, সেদ্ধ সবজি, ভাত, ডাল, মাছ ও মাংস শিশুর জন্য উপকারী।

প্রশ্ন ৫: কম ওজনের শিশুকে কি ঘন ঘন ডাক্তার দেখাতে হবে?
হ্যাঁ, প্রতি মাসে শিশুর ওজন, উচ্চতা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top