গর্ভকালীন ডায়াবেটিস: ভূমিকা-
গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনের বিশেষ সময়। এ সময় শরীরে ঘটে অনেক জটিল পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। এটি এমন এক ধরণের ডায়াবেটিস যা শুধুমাত্র গর্ভাবস্থায় দেখা দেয় এবং সাধারণত প্রসবের পর মিলিয়ে যায়। তবে এর ঝুঁকি ও প্রভাব মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই গুরুতর হতে পারে।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ, ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কী?-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলো এমন এক অবস্থা, যখন গর্ভবতী নারীর শরীরে রক্তের শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। এটি সাধারণত গর্ভধারণের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে দেখা দেয়।
প্রসবের পর অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস মিলিয়ে যায়, তবে ভবিষ্যতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে—
- গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তনের কারণে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া
- ওজন বেশি থাকা বা স্থূলতা
- পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকা
- পূর্বে কোনো গর্ভধারণে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়া
- বয়স ৩০ বছরের বেশি হলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়া
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের অনেক সময় সুস্পষ্ট কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো—
- অস্বাভাবিক তৃষ্ণা পাওয়া
- বারবার প্রস্রাব হওয়া
- অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা
- ঝাপসা দেখা
- অকারণে ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস শুধু মায়ের জন্য নয়, শিশুর জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
মায়ের জন্য ঝুঁকি:
- উচ্চ রক্তচাপ বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া
- সিজারিয়ান ডেলিভারির সম্ভাবনা বৃদ্ধি
- ভবিষ্যতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি
শিশুর জন্য ঝুঁকি:
- শিশুর ওজন অস্বাভাবিক বেশি হওয়া (Macrosomia)
- জন্মের পর শ্বাসকষ্ট
- জন্মের পর রক্তে শর্করা কমে যাওয়া (Hypoglycemia)
- পরবর্তী জীবনে স্থূলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সনাক্ত করার জন্য কয়েকটি টেস্ট করা হয়। যেমন—
- Oral Glucose Tolerance Test (OGTT)
- Fasting Blood Sugar Test
- HbA1c Test
সাধারণত ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে এই টেস্ট করা হয়।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা মূলত জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হয়।
- খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ: শর্করাযুক্ত খাবার কম খেতে হবে। বেশি করে শাকসবজি, ডাল, আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে।
- ব্যায়াম: হালকা হাঁটা বা গর্ভবতীদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যায়াম ডাক্তারের পরামর্শে করা যায়।
- ঔষধ: প্রয়োজনে ডাক্তার ইনসুলিন বা ওষুধ দিতে পারেন।
- রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করা জরুরি।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায়-
সব ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে কিছু অভ্যাস অনুসরণ করলে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
- গর্ভধারণের আগে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
- নিয়মিত ব্যায়াম করা
- সুষম খাবার খাওয়া
- ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত তেল ও চিনি এড়িয়ে চলা
- পর্যাপ্ত ঘুমানো ও মানসিক চাপ কমানো
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও শিশুর সুস্থতা-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে বাড়তি যত্ন নেওয়া জরুরি। নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। প্রসবের পর শিশুর রক্তে শর্করা পরীক্ষা করাও প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ে ভুল ধারণা-
অনেকে মনে করেন গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মানেই মায়ের ডায়াবেটিস আজীবন থাকবে। এটি সঠিক নয়। প্রসবের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস মিলিয়ে যায়। তবে ভবিষ্যতে ঝুঁকি থেকে যায়। তাই প্রসবের পরও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত।
উপসংহার-
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা। সঠিক সময়ে পরীক্ষা, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে মা ও শিশু উভয়েই সুস্থ থাকতে পারে। প্রতিটি গর্ভবতী নারীর উচিত সচেতন থাকা এবং নিয়মিত চেকআপ করা।
প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সাধারণত কখন দেখা দেয়?
উত্তর: সাধারণত গর্ভধারণের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এটি দেখা দেয়।
প্রশ্ন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে কি সন্তান স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিত চেকআপ করতে হবে।
প্রশ্ন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কি স্থায়ী?
উত্তর: না, সাধারণত প্রসবের পর এটি চলে যায়। তবে ভবিষ্যতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এড়াতে কী করা উচিত?
উত্তর: ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম এ ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে কি ইনসুলিন নিতে হয়?
উত্তর: সব ক্ষেত্রে নয়। শুধু যাদের খাদ্য ও ব্যায়াম নিয়ন্ত্রণে রক্তে শর্করা স্বাভাবিক থাকে না, তাদের ডাক্তার ইনসুলিন দিতে পারেন।