গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্ন

গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্ন – স্বাস্থ্যকর গর্ভধারণের সম্পূর্ণ নির্দেশিকা

গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্ন-

গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসকে বলা হয় তৃতীয় ত্রৈমাসিক বা শেষ ত্রৈমাসিক (Third Trimester)। এই সময়টা মা ও শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মস্তিষ্ক, হাড়, ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্রুত বিকাশ লাভ করে। একইসাথে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্ন নেওয়া শুধু মায়ের নয়, অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানবো শেষ তিন মাসে করণীয়, খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে।

গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসের গুরুত্ব-

শেষ তিন মাসে শিশুর ওজন দ্রুত বাড়ে। সাধারণত নবম মাসে গিয়ে শিশুর জন্মের জন্য প্রয়োজনীয় পরিপূর্ণতা আসে। এ সময়ে –

  • শিশুর ফুসফুস তৈরি হয়।
  • হাড় মজবুত হতে থাকে।
  • শিশুর ব্রেইন বা মস্তিষ্ক দ্রুত বিকাশ লাভ করে।
  • শরীরে চর্বি জমতে শুরু করে।

 

শেষ তিন মাসে ভ্রুণের বিকাশ-

এ সময়ে মায়ের পুষ্টি, বিশ্রাম ও মানসিক স্থিতিশীলতা সরাসরি শিশুর স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। শেষ তিন মাসে ভ্রুণের বিকাশ টেবিল এর মাধ্যমে দেয়া হলো-

মাস ভ্রুণের ওজন ও আকার বিকাশের ধাপ
সপ্তম মাস (২৮–৩১ সপ্তাহ) প্রায় ১ – ১.৫ কেজি – চোখ খোলা-বন্ধ করতে পারে- আলো-অন্ধকার বোঝে- মস্তিষ্ক দ্রুত বিকাশ পায়- হাত-পা নাড়াচাড়া স্পষ্ট হয়- ফুসফুস আংশিক তৈরি হয়
অষ্টম মাস (৩২–৩৫ সপ্তাহ) প্রায় ২ কেজির বেশি – শরীরে চর্বি জমা শুরু হয়- হাড় শক্ত হতে থাকে- মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র পরিপূর্ণ হয়- শ্রবণশক্তি ভালোভাবে কাজ করে
নবম মাস (৩৬–৪০ সপ্তাহ) গড়ে ২.৫ – ৩.৫ কেজি – ফুসফুস পুরোপুরি কার্যকর হয়- সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পূর্ণ বিকশিত হয়- চুল, নখ ও চর্বির স্তর বৃদ্ধি পায়- প্রসবের প্রস্তুতিতে মাথা নিচের দিকে ঘুরে যায়

 

গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্নে খাদ্যাভ্যাস-

গর্ভাবস্থার শেষ দিকে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মায়ের শরীরে শক্তি জোগায় এবং শিশুর সুস্থ বিকাশে সহায়তা করে।

পুষ্টিকর খাবার:

  • প্রোটিন: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল ও সয়াবিন।
  • ক্যালসিয়াম: দুধ, দই, পনির, শাকসবজি ও বাদাম।
  • আয়রন: লাল মাংস, ডাল, পালং শাক ও খেজুর।
  • ফোলেট: শাকসবজি, কমলা, ডাল, সবুজ পাতা।
  • ভিটামিন ও খনিজ: ফলমূল ও সবজি প্রতিদিনের খাবারে রাখুন।

যা এড়িয়ে চলতে হবে:

  • অতিরিক্ত তেল-ঝাল ও ভাজাপোড়া খাবার।
  • কাঁচা বা আধা সিদ্ধ মাংস ও ডিম।
  • অতিরিক্ত ক্যাফেইন।
  • ধূমপান, অ্যালকোহল বা যেকোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য।

শেষ তিন মাসে ঘুম ও বিশ্রাম-

গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসে ঘুমের সমস্যা সাধারণ একটি বিষয়। শিশুর আকার বড় হওয়ায় শোওয়ার ভঙ্গিতে অসুবিধা হয়।

  • বাম পাশে শোয়া ভালো কারণ এতে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে এবং শিশুর কাছে অক্সিজেন পৌঁছায়।
  • ৭–৮ ঘণ্টা রাতের ঘুম ও দিনের মধ্যে ছোট্ট বিরতিতে বিশ্রাম নেয়া দরকার।
  • শক্ত বিছানায় ঘুমানো এবং বালিশ দিয়ে কোমর ও হাঁটু সমর্থন দেওয়া আরামদায়ক।

গর্ভবতীর মানসিক স্বাস্থ্য-

শেষ তিন মাসে প্রসব নিয়ে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা বা মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তাই –

  • ধ্যান, নামাজ বা প্রার্থনায় মনোযোগ দিন।
  • পরিবারের সাথে সময় কাটান।
  • প্রয়োজনে মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
  • সঙ্গীত শোনা বা হালকা বই পড়া মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরিবর্তন-

শেষ তিন মাসে মা বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন, যেমন –

  • হাত-পা ফুলে যাওয়া।
  • কোমর ব্যথা।
  • ঘন ঘন প্রস্রাব।
  • বুক জ্বালা।
  • শ্বাসকষ্ট।
  • প্রসব বেদনার মতো মৃদু সংকোচন (Braxton Hicks contractions)।

এসব পরিবর্তন সাধারণ হলেও অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

শেষ তিন মাসে গর্ভবতী মায়ের যত্নে ব্যায়াম-

হালকা ব্যায়াম শরীরকে সক্রিয় রাখে এবং প্রসব সহজ করতে সাহায্য করে।

  • প্রতিদিন ২০–৩০ মিনিট হাঁটা।
  • হালকা যোগ ব্যায়াম ও প্রেগন্যান্সি এক্সারসাইজ।
  • ভারী কাজ বা কঠিন ব্যায়াম এড়িয়ে চলা।
  • যেকোনো ব্যায়ামের আগে চিকিৎসকের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক।

চিকিৎসকের পরামর্শ ও নিয়মিত চেকআপ-

শেষ তিন মাসে চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

  • রক্তচাপ ও রক্তের শর্করা পরীক্ষা।
  • শিশুর অবস্থান পরীক্ষা।
  • আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে শিশুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ।
  • প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন (যেমন TT টিকা)।
  • প্রসবের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে প্রস্তুতি।

প্রসবের প্রস্তুতি-

শেষ তিন মাসে প্রসবের প্রস্তুতি শুরু করা উচিত।

  • প্রসবের হাসপাতাল ও চিকিৎসকের ঠিকানা আগে থেকে ঠিক করে রাখুন।
  • প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পোশাক ব্যাগে গুছিয়ে রাখুন।
  • পরিবারের সদস্যদের সাথে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার পরিকল্পনা করুন।

উপসংহার-

গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্ন অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়। সঠিক খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, মানসিক স্থিতি, হালকা ব্যায়াম ও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মায়ের সুস্থতা ও শিশুর নিরাপদ জন্ম নিশ্চিত করে। তাই শেষ ত্রৈমাসিককে গুরুত্ব দিয়ে কাটানোই হবে একটি স্বাস্থ্যকর মাতৃত্ব ও শিশুর সুস্থ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।

গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসের যত্ন সম্পর্কিত প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১: গর্ভবতী মায়ের শেষ তিন মাসে কোন খাবার সবচেয়ে উপকারী?
উত্তর: দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল ও বাদাম সবচেয়ে উপকারী। এগুলো শিশুর বৃদ্ধি ও মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।

প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থার শেষ দিকে ঘুমাতে সমস্যা হলে কী করবেন?
উত্তর: বাম পাশে শোবেন, বালিশ ব্যবহার করবেন এবং ক্যাফেইন এড়িয়ে চলবেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।

প্রশ্ন ৩: শেষ তিন মাসে কি ব্যায়াম করা নিরাপদ?
উত্তর: হাঁটা ও হালকা ব্যায়াম নিরাপদ, তবে যেকোনো ব্যায়ামের আগে চিকিৎসকের অনুমতি নেওয়া জরুরি।

প্রশ্ন ৪: গর্ভবতী মায়ের মানসিক চাপ কমানোর উপায় কী?
উত্তর: প্রার্থনা, ধ্যান, পরিবারের সাথে সময় কাটানো ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া চাপ কমাতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন ৫: কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
উত্তর: অতিরিক্ত রক্তপাত, প্রচণ্ড ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, ঝাপসা দেখা বা শিশুর নড়াচড়া কমে গেলে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top