গর্ভাবস্থায় ইডেমা বা শরীরে পানি আসা – কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও সঠিক যত্ন

গর্ভাবস্থায় ইডেমা কী?-

গর্ভাবস্থায় ইডেমা (Edema) হলো শরীরের বিভিন্ন স্থানে অস্বাভাবিকভাবে পানি জমে ফুলে যাওয়ার একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত এটি দেখা যায় পা, গোড়ালি, হাত, মুখ এবং পায়ের আঙুলে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে অতিরিক্ত রক্ত ও তরল উৎপন্ন হয়, যা শিশুর বিকাশে সহায়তা করে। তবে এর ফলেই শরীরে কিছু পরিমাণ পানি জমে ফোলাভাব তৈরি হতে পারে।

গর্ভবতী নারীদের প্রায় ৭০-৮০% এই সমস্যার মুখোমুখি হন, বিশেষত গর্ভাবস্থার শেষ দিকে (তৃতীয় ত্রৈমাসিক)। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি ক্ষতিকর নয়, কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া বা অন্যান্য জটিলতার ইঙ্গিতও হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ইডেমার কারণ-

গর্ভাবস্থায় ইডেমা হওয়ার পেছনে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় কারণ রয়েছে। এগুলো হলো—

  • রক্ত ও তরলের পরিমাণ বৃদ্ধি: গর্ভাবস্থায় শিশুর প্রয়োজন মেটাতে মায়ের শরীরে ৫০% পর্যন্ত বেশি রক্ত ও তরল তৈরি হয়।
  • হরমোনজনিত পরিবর্তন: প্রোজেস্টেরনসহ বিভিন্ন হরমোন শরীরের রক্তনালীগুলোকে ঢিলে করে দেয়, ফলে তরল সহজেই টিস্যুতে জমে যায়।
  • বর্ধমান গর্ভাশয়ের চাপ: শিশুর বৃদ্ধি পেলে জরায়ু নিচের দিকের শিরাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে রক্ত সঞ্চালনে বাধা পায়।
  • অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: খাদ্যে বেশি লবণ খেলে শরীরে পানি ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ে।
  • দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা: একটানা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে শরীরে রক্ত জমে ফোলাভাব হয়।
  • গরম আবহাওয়া: তাপমাত্রা বেড়ে গেলে রক্তনালী প্রসারিত হয়, ফলে তরল টিস্যুতে জমে যায়।

গর্ভাবস্থায় ইডেমার লক্ষণ-

গর্ভাবস্থায় ইডেমার সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো শরীরের কিছু অংশে ফোলাভাব। নিচে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেওয়া হলো—

  • পা, গোড়ালি, বা আঙুল ফুলে যাওয়া
  • হাত বা আঙুলে টান টান অনুভব
  • মুখে হালকা ফোলাভাব
  • জুতা বা আংটি টাইট হয়ে যাওয়া
  • শরীরে ভার অনুভব বা অস্বস্তি
  • সন্ধিবন্ধনীর আশেপাশে ব্যথা

এই ফোলাভাব সাধারণত দিনের শেষে বা গরম আবহাওয়ায় বেশি হয় এবং বিশ্রাম বা ঘুমের পর কিছুটা কমে আসে।

গর্ভাবস্থায় ইডেমা কি বিপজ্জনক?-

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় ইডেমা ক্ষতিকর নয় এবং এটি স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তনের অংশ। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া (Preeclampsia) নামক গুরুতর অবস্থার লক্ষণ হতে পারে, যা রক্তচাপ বৃদ্ধি ও প্রস্রাবে প্রোটিন উপস্থিতির কারণে হয়।

নিচের লক্ষণগুলো থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:

  • হঠাৎ মুখ বা চোখের চারপাশে অতিরিক্ত ফোলাভাব
  • তীব্র মাথাব্যথা
  • ঝাপসা দেখা বা চোখে ব্যথা
  • পেটের ডান পাশে ব্যথা
  • উচ্চ রক্তচাপ

গর্ভাবস্থায় ইডেমা কবে বেশি হয়?-

ইডেমা সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাহ পর থেকে শুরু হয় এবং শেষ ত্রৈমাসিকে (৭-৯ মাসে) বেশি দেখা যায়।
এ সময় শিশুর বৃদ্ধি দ্রুত হয়, জরায়ুর আকার বাড়ে এবং রক্তনালীর ওপর চাপ পড়ে।

কিছু নারী গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই হালকা ফোলাভাব অনুভব করতে পারেন, বিশেষ করে গরমে বা অতিরিক্ত কাজের কারণে।

গর্ভাবস্থায় ইডেমার চিকিৎসা-

গর্ভাবস্থায় ইডেমার জন্য সাধারণত ওষুধের প্রয়োজন হয় না। তবে কিছু ঘরোয়া উপায় ও চিকিৎসকের পরামর্শে যত্ন নিলে এই ফোলাভাব কমানো যায়।

চিকিৎসা ও যত্নের উপায়

  • বিশ্রাম নিন এবং পা উঁচু করে রাখুন
  • প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন
  • খাদ্যে লবণ কমান
  • হালকা ব্যায়াম (যেমন হাঁটা বা প্রেনাটাল যোগা) করুন
  • ঢিলেঢালা পোশাক পরুন
  • গরমে ঠান্ডা পানি দিয়ে পা ধুয়ে নিন
  • দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না
  • ঘুমানোর সময় বাম পাশে কাত হয়ে শোবেন (এতে রক্ত চলাচল সহজ হয়)

চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া কোনো ডায়ুরেটিক বা ওষুধ খাওয়া উচিত নয়, কারণ তা শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ইডেমায় খাদ্যাভ্যাস-

খাবারের মাধ্যমে ইডেমা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

যা খাওয়া উচিত:

  • তাজা ফল ও শাকসবজি (পটাশিয়ামযুক্ত যেমন কলা, টমেটো, লাউ)
  • পর্যাপ্ত পানি ও ডাবের পানি
  • সম্পূর্ণ শস্য ও ওটস
  • ভিটামিন বি ও সি সমৃদ্ধ খাবার

যা এড়িয়ে চলা উচিত:

  • অতিরিক্ত লবণ ও প্রক্রিয়াজাত খাবার
  • সফট ড্রিংকস ও অতিরিক্ত চা/কফি
  • তৈলাক্ত ও মশলাযুক্ত খাবার

গর্ভাবস্থায় ইডেমা কমানোর ঘরোয়া উপায়-

কিছু সহজ ঘরোয়া পদ্ধতিতে গর্ভাবস্থার ফোলাভাব বা ইডেমা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়—

  • পানিতে ডুবিয়ে পা রাখা: হালকা ঠান্ডা পানিতে ১৫-২০ মিনিট পা রাখলে আরাম পাওয়া যায়।
  • হালকা ম্যাসাজ: নারকেল বা অলিভ অয়েল দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে।
  • পা উঁচু করে বসা: পা একটু উঁচু করে রাখলে তরল নিচে জমে থাকতে পারে না।
  • কম্প্রেশন স্টকিংস: বিশেষ ধরণের মোজা ব্যবহার করলে রক্ত চলাচল উন্নত হয় এবং ফোলাভাব কমে।

গর্ভাবস্থায় ইডেমা ও ব্যায়াম-

হালকা ব্যায়াম ইডেমা কমাতে দারুণ কার্যকর।
নিচে কিছু নিরাপদ ব্যায়ামের নাম দেওয়া হলো—

  • হাঁটা: প্রতিদিন ২০–৩০ মিনিট হাঁটা রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে।
  • পা ঘোরানো: বসে থেকে পায়ের গোড়ালি ঘুরালে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়।
  • প্রেনাটাল যোগা: নির্দিষ্ট যোগাসন শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে ও তরল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।

গর্ভাবস্থায় ইডেমা প্রতিরোধ-

ইডেমা প্রতিরোধে কিছু সাধারণ অভ্যাস মেনে চলা উচিত—

  • শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা
  • নিয়মিত হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা
  • আরামদায়ক জুতা ও পোশাক পরা
  • দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে না থাকা
  • পা উঁচু করে বিশ্রাম নেওয়া
  • পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম

গর্ভাবস্থায় ইডেমা কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?-

নিম্নলিখিত অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন:

  • হঠাৎ ফোলাভাব বেড়ে গেলে
  • মুখ, চোখ বা হাতে অতিরিক্ত ফোলাভাব দেখা দিলে
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
  • মাথাব্যথা বা চোখে ঝাপসা দেখা দিলে
  • প্রস্রাবে প্রোটিন বা রক্ত দেখা দিলে

এগুলো প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়া বা হৃদরোগজনিত ইডেমার লক্ষণ হতে পারে, যা মা ও শিশুর জন্য বিপজ্জনক।

গর্ভাবস্থায় ইডেমা প্রসবের পর কী হয়?-

প্রসবের পর সাধারণত ইডেমা ধীরে ধীরে কমে যায়। প্রসবের ১–২ সপ্তাহের মধ্যে অতিরিক্ত পানি প্রস্রাব ও ঘামের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।
তবে যদি দীর্ঘ সময় ফোলাভাব থেকে যায়, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

উপসংহার-

গর্ভাবস্থায় ইডেমা বা শরীরে পানি আসা গর্ভবতী নারীর একটি স্বাভাবিক কিন্তু অস্বস্তিকর শারীরিক পরিবর্তন। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি ক্ষতিকর নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে তা জটিল রোগের ইঙ্গিত হতে পারে। তাই এই সময় সঠিক বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাদ্য, ও নিয়মিত চিকিৎসা পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিজেকে যত্নে রাখলে মা ও শিশুর দুজনেরই সুস্থতা বজায় থাকে।

প্রশ্নোত্তর-

১. গর্ভাবস্থায় ইডেমা কখন থেকে শুরু হয়?
সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তাহের পর থেকে ফোলাভাব শুরু হয়, তবে কিছু নারীর ক্ষেত্রে আগে দেখা দিতে পারে।

২. গর্ভাবস্থায় পা ফুলে গেলে কী করবেন?
পা উঁচু করে বিশ্রাম নিন, ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং অতিরিক্ত লবণ খাওয়া কমান।

৩. ইডেমা কি প্রি-এক্ল্যাম্পসিয়ার লক্ষণ?
সবসময় নয়, তবে মুখ ও চোখে হঠাৎ ফোলাভাব, মাথাব্যথা বা দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হলে দ্রুত চিকিৎসককে দেখান।

৪. গর্ভাবস্থায় ইডেমা কমাতে ব্যায়াম করা নিরাপদ কি?
হ্যাঁ, হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা ও প্রেনাটাল যোগা নিরাপদ এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।

৫. প্রসবের পর কি ইডেমা নিজে থেকেই সেরে যায়?
হ্যাঁ, সাধারণত প্রসবের ১–২ সপ্তাহের মধ্যে ফোলাভাব কমে যায়। তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top