গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন: করণীয়, গুরুত্ব ও সমস্যার সমাধান

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন-

গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সময়ে শুধু শরীরের নয়, দাঁত এবং মাড়িরও বিশেষ যত্ন প্রয়োজন হয়। গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে যা দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। অনেক সময় দেখা যায়, গর্ভবতী মা নিজের শরীরের সাধারণ যত্ন নিলেও দাঁতের যত্নকে অবহেলা করেন। অথচ দাঁতের সামান্য সমস্যা থেকেও বড় জটিলতা তৈরি হতে পারে, যা মা ও অনাগত সন্তানের জন্য ক্ষতিকর। তাই গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নেওয়া একান্ত জরুরি।

গর্ভাবস্থায় দাঁতের সমস্যা কেন বেশি হয়?-

১. হরমোন পরিবর্তন – ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাড়ি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।
২. বমি হওয়া – গর্ভাবস্থার শুরুতে বমি হলে দাঁতে অ্যাসিড জমে দাঁতের ক্ষয় হয়।
৩. খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন – বেশি মিষ্টি বা টকজাতীয় খাবার খেলে দাঁত নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
৪. মুখের পরিচ্ছন্নতার অভাব – ক্লান্তি ও অবহেলার কারণে অনেক মা দাঁতের সঠিক যত্ন নিতে পারেন না।
৫. লালার পরিবর্তন – অনেক সময় লালা কমে গিয়ে মুখ শুকিয়ে যায়, ফলে দাঁতের ক্ষয় দ্রুত হয়।

গর্ভাবস্থায় সাধারণ দাঁতের সমস্যা-

১. মাড়ি ফোলা ও রক্তপাত (Pregnancy Gingivitis)
২. দাঁতের ক্ষয় (Dental Caries)
৩. মুখে দুর্গন্ধ (Halitosis)
৪. পেরিওডোন্টাল ডিজিজ
৫. দাঁতে ব্যথা ও সংবেদনশীলতা

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন কেন গুরুত্বপূর্ণ?-

  • মাড়ি ও দাঁতের সংক্রমণ অকাল প্রসবের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • দাঁতের ব্যথার কারণে খাবার খেতে সমস্যা হয়, ফলে মা ও শিশুর পুষ্টি ঘাটতি হতে পারে।
  • দাঁতের যত্ন নিলে মা মানসিকভাবে স্বস্তি পান।
  • মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সামগ্রিক শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্নের উপায়-

১. প্রতিদিন অন্তত দুইবার ব্রাশ করা।
২. দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাবার ফ্লস দিয়ে পরিষ্কার করা।
৩. অ্যালকোহলমুক্ত মাউথওয়াশ ব্যবহার করা।
৪. ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
৫. প্রচুর পানি পান করা।
৬. লবণ পানিতে কুলি করা ও লবঙ্গ তেল ব্যবহার করা।
৭. নিয়মিত দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

গর্ভাবস্থায় দাঁতের চিকিৎসা কি নিরাপদ?-

  • প্রথম তিন মাসে বড় ধরনের চিকিৎসা এড়িয়ে চলা ভালো।
  • দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক দাঁতের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ সময়।
  • দাঁত পরিষ্কার (Scaling) করা নিরাপদ।
  • এক্স-রে জরুরি হলে সুরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে করা যায়।

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্নে করণীয়-

১. প্রতিদিন দুইবার দাঁত ব্রাশ করা।
২. কাঁচা শাকসবজি খাওয়া।
৩. ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
৪. দাঁতের সমস্যা হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্নে যা এড়িয়ে চলবেন-

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি, তবে কিছু বিষয় এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। কারণ এ সময়ে মায়ের সামান্য অবহেলাও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নিচে গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্নে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে তা তুলে ধরা হলোঃ

১. অতিরিক্ত এক্স-রে করা – গর্ভাবস্থায় দাঁতের চিকিৎসার সময় অপ্রয়োজনীয় এক্স-রে এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এক্স-রে করানো উচিত নয়।

২. অতিরিক্ত শক্ত দাঁত পরিষ্কারক বা কেমিক্যাল ব্যবহার – তীব্র রাসায়নিকযুক্ত টুথপেস্ট বা মাউথওয়াশ ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে। এগুলো দাঁতের মাড়িতে জ্বালাভাব সৃষ্টি করতে পারে।

৩. শক্ত ব্রাশ ব্যবহার করা – শক্ত ব্রাশ দাঁতের এনামেল ক্ষতি করতে পারে এবং মাড়ি থেকে রক্তপাত ঘটাতে পারে। গর্ভাবস্থায় নরম ব্রাশ ব্যবহার করা উচিত।

৪. মিষ্টি ও জাঙ্ক ফুড অতিরিক্ত খাওয়া – অতিরিক্ত মিষ্টি, চকলেট, সফট ড্রিংকস বা জাঙ্ক ফুড খেলে দাঁতে ক্যাভিটি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলা জরুরি।

৫. অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন – দাঁতের ব্যথা বা অন্য কোনো সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। অনেক ওষুধ গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৬. অতিরিক্ত দাঁত ফর্সা করার প্রক্রিয়া (Teeth Whitening) – গর্ভাবস্থায় কেমিক্যাল-ভিত্তিক দাঁত ফর্সা করার প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা ভালো।

৭. চিকিৎসককে না জানানো – দাঁতের চিকিৎসার সময় চিকিৎসককে গর্ভাবস্থার কথা অবশ্যই জানাতে হবে। না জানালে চিকিৎসক এমন কোনো চিকিৎসা করতে পারেন যা মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

গর্ভকালীন দাঁতের যত্নে ঘরোয়া টিপস-

  • দিনে ২-৩ বার লবণ পানি দিয়ে কুলি করা।
  • কাঁচা গাজর, শসা ও আপেল খেলে দাঁত মজবুত হয়।
  • দুধ, দই ও ডিম দাঁতের জন্য উপকারী।
  • চিনি ছাড়া চুইংগাম খাওয়া মুখের ব্যাকটেরিয়া কমায়।

গর্ভাবস্থায় দাঁতের সমস্যায় শিশুর ওপর প্রভাব-

  • অকাল প্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • নবজাতকের ওজন কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে।

তাই গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন নেওয়া মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।

উপসংহার-

গর্ভাবস্থায় দাঁতের যত্ন কেবল মায়ের জন্য নয়, অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্রাশ, ফ্লস, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত পানি পান এবং দন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে দাঁতের জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই গর্ভকালীন সময় দাঁতের যত্নকে অবহেলা না করে, এটিকে দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ করুন।

প্রশ্নত্তোর-

১. গর্ভাবস্থায় দাঁত উঠানো কি নিরাপদ?
হ্যাঁ, তবে জরুরি হলে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে করা উচিত এবং অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

২. গর্ভাবস্থায় দাঁতের এক্স-রে করা যায় কি?
সাধারণত এড়িয়ে চলা ভালো, তবে জরুরি হলে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে করা সম্ভব।

৩. গর্ভাবস্থায় দাঁতের ব্যথা হলে কী করবেন?
প্রথমে লবণ পানি দিয়ে গার্গল করুন। ব্যথা না কমলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

৪. দাঁত পরিষ্কার করা (Scaling) কি গর্ভাবস্থায় নিরাপদ?
হ্যাঁ, এটি দাঁতের সমস্যার ঝুঁকি কমায় এবং গর্ভবতী মায়ের জন্য নিরাপদ।

৫. দাঁতের সমস্যায় কি শিশুর ক্ষতি হতে পারে?
হ্যাঁ, মারাত্মক মাড়ির সংক্রমণ শিশুর অকাল জন্ম ও কম ওজনের ঝুঁকি বাড়ায়।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top