গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি-
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের এক অসাধারণ অধ্যায়, তবে এই সময় শরীরে নানা পরিবর্তনের কারণে কিছু অস্বস্তিকর উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ এবং কষ্টদায়ক একটি সমস্যা হলো গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি। অনেক নারী গর্ভধারণের প্রথম দিকে সকালবেলা হালকা বমি বা বমি বমি ভাব অনুভব করেন, যাকে সাধারণত মর্নিং সিকনেস বলা হয়। কিন্তু কিছু নারীর ক্ষেত্রে এই বমি এত বেশি হয় যে তা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে কঠিন করে তোলে।
এই লেখায় আমরা বিস্তারিত জানবো গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমির কারণ, প্রতিকার, ঝুঁকি এবং করণীয়।
গর্ভাবস্থায় বমি কখন শুরু হয়-
গর্ভাবস্থার প্রথম ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে সাধারণত বমি শুরু হয় এবং ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে তা ধীরে ধীরে কমে আসে। তবে কিছু নারীর ক্ষেত্রে পুরো গর্ভকাল জুড়েও বমি চলতে পারে।
যখন বমি এত বেশি হয় যে শরীর পানিশূন্য হয়ে যায় এবং ওজন কমতে শুরু করে, তখন একে চিকিৎসা পরিভাষায় হাইপারেমেসিস গ্রাভিডারাম বলা হয়। এটি গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমির গুরুতর একটি রূপ।
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমির কারণ-
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমির পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
- হরমোনের পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় শরীরে hCG এবং ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা মস্তিষ্কের বমি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে। - সংবেদনশীল গন্ধ বা স্বাদ
গর্ভবতী নারীরা অনেক সময় তীব্র গন্ধ বা নির্দিষ্ট খাবারের প্রতি অতিসংবেদনশীল হয়ে পড়েন, যা বমির কারণ হতে পারে। - মানসিক চাপ ও ক্লান্তি
অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা ক্লান্তি বমিকে বাড়িয়ে দিতে পারে। - একাধিক গর্ভধারণ
একাধিক শিশু গর্ভে থাকলে হরমোনের মাত্রা দ্বিগুণ হয়, ফলে বমির প্রবণতাও বেড়ে যায়। - পরিবারগত কারণ
পরিবারে কারো গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমির ইতিহাস থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেও এর সম্ভাবনা বেশি থাকে।
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমির ঝুঁকি-
অতিরিক্ত বমি কেবল অস্বস্তিকর নয়, বরং এটি নানা শারীরিক জটিলতার কারণ হতে পারে। যেমন
- পানি শূন্যতা
- ওজন হ্রাস
- ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা
- অবসাদ ও দুর্বলতা
- রক্তচাপ কমে যাওয়া
- পুষ্টিহীনতা
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি নিয়ন্ত্রণে করণীয়-
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কিছু উপায় অবলম্বন করলে এটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
- অল্প অল্প করে বারবার খাবার খান।
- সকালে বিছানা থেকে ওঠার আগে শুকনো বিস্কুট বা টোস্ট খেয়ে নিন।
- তৈলাক্ত ও গন্ধযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার যেমন ফলের রস, স্যুপ ইত্যাদি গ্রহণ করুন।
- বিশ্রাম ও ঘুম যথেষ্ট নিন।
- হালকা হাঁটাহাঁটি করুন এবং ঘরের বাতাস চলাচল রাখুন।
কখন ডাক্তার দেখাবেন-
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি যদি নিচের মতো অবস্থায় পৌঁছে যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
- দিনে একাধিকবার বমি হয়ে কিছুই পেটে থাকছে না
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- তীব্র পেটব্যথা
- ওজন হ্রাস
- মুখ ও ঠোঁট শুষ্ক হয়ে যাওয়া
এই অবস্থায় ডাক্তার প্রয়োজনীয় ওষুধ বা আইভি ফ্লুইড দিতে পারেন।
হাইপারেমেসিস গ্রাভিডারাম-
যখন বমি এত বেশি হয় যে মা কোনো খাবার বা পানি পেটে রাখতে পারেন না, তখন সেটি হাইপারেমেসিস গ্রাভিডারাম নামে পরিচিত।
এর লক্ষণসমূহ
- দিনে তিন থেকে পাঁচ বারের বেশি বমি
- ওজন দ্রুত কমে যাওয়া
- প্রস্রাবের রং গাঢ় হওয়া
- দুর্বলতা ও মাথা ঘোরা
- শরীরে পানি ও লবণের ঘাটতি
চিকিৎসা
- হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আইভি ফ্লুইড দেওয়া হয়
- অ্যান্টিএমেটিক ওষুধ দেওয়া হতে পারে
- ধীরে ধীরে তরল খাবার ও পুষ্টিকর খাবার শুরু করা হয়
গর্ভাবস্থায় বমি কমাতে উপকারী কিছু খাবার-
খাবারের নাম | উপকারিতা |
---|---|
আদা | বমি কমাতে সাহায্য করে |
লেবু | মুখে সতেজ ভাব আনে |
কলা | শক্তি জোগায় ও পেট শান্ত রাখে |
শুকনো বিস্কুট বা টোস্ট | খালি পেটের বমি প্রতিরোধ করে |
নারকেল পানি | পানিশূন্যতা রোধ করে |
যেসব খাবার ও অভ্যাস এড়িয়ে চলা উচিত-
- তৈলাক্ত ও মসলাযুক্ত খাবার
- অতিরিক্ত চা বা কফি
- ধূমপান বা পরোক্ষ ধোঁয়া
- দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকা
- অতিরিক্ত গরম বা আর্দ্র জায়গায় থাকা
মানসিক যত্ন-
গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ বমিকে আরও বাড়াতে পারে। তাই নিজেকে শান্ত রাখুন, প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটান, নিয়মিত নামাজ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন। নিজের প্রতি যত্নশীল হোন, কারণ এখন আপনার শরীরের ভেতর একটি নতুন প্রাণ বেড়ে উঠছে।
পানি শূন্যতা রোধের উপায়-
- প্রতি ঘণ্টায় অল্প অল্প করে পানি পান করুন।
- লেবু পানি বা ওআরএস খান।
- ফলের রস ও স্যুপ খেতে পারেন।
- বরফের টুকরো চুষে মুখ সতেজ রাখুন।
অতিরিক্ত বমির প্রভাব শিশুর উপর-
সাধারণত গর্ভাবস্থায় বমি শিশুর ক্ষতি করে না যদি মা যথেষ্ট তরল ও পুষ্টি গ্রহণ করেন। তবে দীর্ঘদিন অবহেলা করলে শিশুর ওজন কম হতে পারে, সময়ের আগে প্রসবের ঝুঁকি বাড়ে এবং শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে।
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি অনেক সময় ভয়ানক মনে হলেও এটি সাধারণত নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি অবস্থা। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ও চিকিৎসকের পরামর্শে এটি সহজেই সামাল দেওয়া যায়। নিজের যত্ন নেওয়া মানেই আপনার শিশুর যত্ন নেওয়া, তাই গর্ভাবস্থায় নিজের স্বাস্থ্য ও মানসিক শান্তির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিন।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত বমি কতদিন থাকে?
সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে বেশি হয় এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে কমে যায়।
প্রশ্ন ২: অতিরিক্ত বমি হলে কী খাবার খাওয়া উচিত?
আদা, লেবু, শুকনো বিস্কুট, কলা ও নারকেল পানি খাওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ৩: বমির কারণে পানি শূন্য হলে কী করব?
ওআরএস, স্যুপ বা লেবু পানি পান করুন। গুরুতর হলে হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।
প্রশ্ন ৪: বমি প্রতিরোধে ওষুধ খাওয়া যায় কি?
হ্যাঁ, তবে শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে। নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক।
প্রশ্ন ৫: অতিরিক্ত বমি শিশুর জন্য ক্ষতিকর কি না?
সাধারণত নয়, তবে মায়ের শরীরে পুষ্টি ও পানির ঘাটতি হলে শিশুর বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে।