গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং: ভূমিকা-
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে অনেক মায়ের মনে প্রশ্ন আসে—গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং করা কি নিরাপদ? এটি কি মায়ের শরীরে কোনো ক্ষতি করে, নাকি গর্ভস্থ শিশুর জন্য বিপদজনক? প্রকৃতপক্ষে, চিকিৎসকের পরামর্শ ও শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং করা সম্ভব এবং এটি অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ। এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানবো গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং-এর উপকারিতা, ঝুঁকি, করণীয়, সতর্কতা এবং FAQs।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং কী?-
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে মা নতুন করে গর্ভবতী হলেও তার আগের সন্তানকে দুধ পান করিয়ে থাকেন। একে মেডিকেল ভাষায় “ট্যান্ডেম নার্সিং” বলা হয়।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং নিরাপদ কি?-
সাধারণত সুস্থ মায়েদের জন্য গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং নিরাপদ। তবে কিছু পরিস্থিতিতে এটি এড়িয়ে চলা উচিত, যেমন:
- গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকলে
- প্রিম্যাচিউর ডেলিভারির ইতিহাস থাকলে
- জরায়ুর জটিলতা বা রক্তপাত হলে
- মায়ের শরীরে অতিরিক্ত দুর্বলতা থাকলে
চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ নিয়ে ব্রেস্টফীডিং চালিয়ে যাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং-এর উপকারিতা-
- আগের সন্তানের মানসিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি
হঠাৎ করে দুধ বন্ধ করে দিলে শিশু মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। ব্রেস্টফীডিং চালিয়ে গেলে সে নিরাপত্তা ও স্নেহ অনুভব করে। - মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধন মজবুত হয়
স্তন্যপান শুধু পুষ্টির উৎস নয়, এটি মা ও সন্তানের মধ্যে আবেগময় সম্পর্ক তৈরি করে। - শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
ব্রেস্টমিল্কে থাকা অ্যান্টিবডি শিশুকে নানা রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। - প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ
মায়ের দুধ সবসময়ই শিশুর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত খাদ্য।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং-এর ঝুঁকি-
- গর্ভাশয়ে সংকোচন (Uterine Contraction): ব্রেস্টফীডিং করার সময় অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসৃত হয় যা জরায়ুতে হালকা সংকোচন তৈরি করতে পারে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় এটি সমস্যা হতে পারে।
- পুষ্টির ঘাটতি: মা যদি সঠিক খাদ্যাভ্যাস না অনুসরণ করেন, তবে শরীরে পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে যা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
- শারীরিক ক্লান্তি: মায়ের শরীর একসাথে গর্ভধারণ ও ব্রেস্টফীডিং-এর চাপ সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং চালিয়ে গেলে মায়ের করণীয়-
সুষম খাদ্য গ্রহণ
-প্রচুর শাকসবজি, ফল, প্রোটিন (ডিম, মাছ, মাংস, ডাল), দুধ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
-পর্যাপ্ত আয়রন ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
পর্যাপ্ত পানি পান
-শরীর হাইড্রেটেড রাখা জরুরি।
যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া
-ব্রেস্টফীডিং ও গর্ভাবস্থার কারণে শরীর ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে, তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন।
চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ
-ওজন, রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, শিশুর বৃদ্ধি—সবকিছু নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
সঠিক পজিশন মেনে চলা
-ব্রেস্টফীডিং-এর সময় আরামদায়ক ভঙ্গি নিতে হবে, যাতে মায়ের শরীরে চাপ না পড়ে।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং কখন বন্ধ করা উচিত?-
- যদি চিকিৎসক পরামর্শ দেন
- গর্ভাশয়ে তীব্র সংকোচন অনুভূত হয়
- অতিরিক্ত রক্তপাত শুরু হয়
- মায়ের শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা দেখা দেয়
- আগের সন্তানের বয়স ২ বছরের বেশি হয়ে যায়
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং ও নতুন শিশুর জন্য প্রস্তুতি-
অনেক মা চিন্তিত থাকেন, নতুন শিশুর জন্মের পর দুধ কি দুইজন সন্তানের জন্য যথেষ্ট হবে?
উত্তর হলো—হ্যাঁ, সম্ভব। প্রসবের পর কলোস্ট্রাম (প্রথম দুধ) সবচেয়ে উপকারী এবং এটি অবশ্যই নবজাতককে আগে খাওয়াতে হবে। এরপর বড় সন্তান চাইলে স্তন্যপান চালিয়ে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা-
- ধারণা: গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং করলে দুধ শুকিয়ে যায়।
বাস্তবতা: সঠিক খাদ্য গ্রহণ করলে দুধের সরবরাহ থাকে, তবে কিছু মায়ের ক্ষেত্রে দুধের স্বাদ পরিবর্তিত হতে পারে। - ধারণা: ব্রেস্টফীডিং করলে গর্ভপাত হয়।
বাস্তবতা: সুস্থ গর্ভাবস্থায় সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে চিকিৎসক পরামর্শ দেন বন্ধ করতে। - ধারণা: একসাথে দুই শিশুকে দুধ খাওয়ানো ক্ষতিকর।
বাস্তবতা: চিকিৎসকের অনুমতি থাকলে এটি নিরাপদ এবং দুই সন্তানই দুধের উপকার পেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং-এর জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা-
খাদ্যগ্রুপ | প্রয়োজনীয় খাবার | উপকারিতা |
---|---|---|
প্রোটিন | মাছ, মাংস, ডিম, ডাল | মা ও শিশুর কোষ গঠনে সহায়তা করে |
ক্যালসিয়াম | দুধ, দই, চিজ, শাকসবজি | হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে |
আয়রন | কলিজা, পালং শাক, ডাল | রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে |
ভিটামিন সি | লেবু, কমলা, আমলকি | আয়রন শোষণে সহায়তা করে |
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট | বাদাম, অলিভ অয়েল | মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে |
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং একটি স্বাভাবিক ও অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ প্রক্রিয়া। এটি শুধু আগের সন্তানকে পুষ্টি জোগায় না, মায়ের সাথে মানসিক বন্ধনও দৃঢ় করে। তবে মায়ের উচিত সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ করা। কোনো জটিলতা দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং করলে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হয় কি?
উত্তর: সাধারণত ক্ষতি হয় না। তবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় দুধ কমে গেলে কী করা উচিত?
উত্তর: সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত পানি ও বিশ্রাম নিলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় ব্রেস্টফীডিং বন্ধ করার সঠিক সময় কখন?
উত্তর: চিকিৎসকের পরামর্শে, মায়ের শরীর দুর্বল হলে অথবা আগের সন্তানের বয়স ২ বছর অতিক্রম করলে।
প্রশ্ন ৪: নতুন শিশুর জন্মের পর কি দুইজন সন্তানকে ব্রেস্টফীডিং করানো যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে নবজাতককে আগে কলোস্ট্রাম খাওয়াতে হবে।
প্রশ্ন ৫: ব্রেস্টফীডিং করলে কি গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে?
উত্তর: সুস্থ গর্ভাবস্থায় সাধারণত ঝুঁকি নেই। তবে রক্তপাত বা সংকোচন হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।