গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন-
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সময় শরীরের ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন বৃদ্ধি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কতটা ওজন বাড়া স্বাভাবিক? ওজন না বাড়লে বা অতিরিক্ত বাড়লে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে? এবং কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব? এই আর্টিকেলে আমরা ধাপে ধাপে আলোচনা করবো গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন নিয়ে সবকিছু।
গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধির স্বাভাবিক ধারা-
গর্ভাবস্থায় ওজন একবারে বাড়ে না, ধাপে ধাপে প্রতিটি ট্রাইমেস্টারে এর ভিন্ন ভিন্ন ধারা দেখা যায়।
গর্ভাবস্থার ধাপ | ওজন বৃদ্ধির স্বাভাবিক হার | মোট বৃদ্ধি |
---|---|---|
প্রথম ৩ মাস (১ম ট্রাইমেস্টার) | ১-২ কেজি | ১-২ কেজি |
দ্বিতীয় ৩ মাস (২য় ট্রাইমেস্টার) | প্রতি সপ্তাহে ০.৪-০.৫ কেজি | ৫-৬ কেজি |
শেষ ৩ মাস (৩য় ট্রাইমেস্টার) | প্রতি সপ্তাহে ০.৫ কেজি | ৪-৫ কেজি |
মোট | — | ১০-১৫ কেজি |
গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধির মূল কারণ-
গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে শুধু চর্বি জমার কারণে ওজন বাড়ে না। এর মধ্যে রয়েছে—
- শিশুর ওজন: ২.৫-৩.৫ কেজি
- প্লাসেন্টা: ০.৫-১ কেজি
- অ্যামনিওটিক ফ্লুইড: ১ কেজি
- বর্ধিত জরায়ু: ১ কেজি
- স্তনের টিস্যু বৃদ্ধি: ১-১.৫ কেজি
- বর্ধিত রক্ত ও তরল: ২-৩ কেজি
- মায়ের শরীরে সঞ্চিত পুষ্টি: ২-৩ কেজি
সব মিলিয়ে মোট ১০-১৫ কেজি ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক।
BMI অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন কতটা বাড়া উচিত?-
গর্ভাবস্থার আগে মায়ের BMI (Body Mass Index) অনুযায়ী ওজন বাড়ার হার নির্ধারিত হয়।
BMI (গর্ভের আগে) | ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ |
---|---|
কম ওজন (<১৮.৫) | ১৩-১৮ কেজি |
স্বাভাবিক (১৮.৫-২৯.৪) | ১১-১৫ কেজি |
অতিরিক্ত ওজন (২৫-২৯.৯) | ৭-১১ কেজি |
স্থূলতা (>৩০) | ৫-৯ কেজি |
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি-
যদি ওজন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেড়ে যায়, তবে হতে পারে—
১. গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস
২. উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-এক্ল্যামসিয়া
৩. প্রসবের সময় জটিলতা
৪. সিজারিয়ান ডেলিভারির ঝুঁকি
৫. বড় শিশুর জন্ম (ম্যাক্রোসোমিয়া)
গর্ভাবস্থায় কম ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি-
অন্যদিকে, ওজন না বাড়লে সমস্যা হতে পারে—
১. শিশুর জন্মের সময় কম ওজন (লবডবাবি)
২. প্রি-ম্যাচিউর ডেলিভারি
৩. শিশুর বিকাশে জটিলতা
৪. মায়ের শরীর দুর্বল হয়ে পড়া
গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়-
১. সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন – প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাবেন।
২. ছোট ছোট মিল খাবেন – একবারে বেশি না খেয়ে দিনে ৫-৬ বার অল্প অল্প করে খাবেন।
৩. পানি পর্যাপ্ত পান করুন – প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা জরুরি।
৪. হালকা ব্যায়াম করুন – ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে হাঁটা, যোগব্যায়াম করতে পারেন।
৫. ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন – তেলেভাজা, জাঙ্ক ফুড ও চিনি কম খাবেন।
গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা-
শর্করা (কার্বোহাইড্রেট): ভাত, রুটি, ওটস
প্রোটিন: মাছ, মুরগি, ডিম, ডাল
দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই, পনির
শাকসবজি ও ফলমূল: পালং শাক, গাজর, আপেল, কলা, কমলা
ভিটামিন সি: লেবু, কমলা, টমেটো
বাদাম ও বীজ: কাঠবাদাম, আখরোট, সূর্যমুখী বীজ
গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন ও মানসিক স্বাস্থ্য-
ওজনের পরিবর্তন অনেক সময় মায়ের আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত ওজন মানসিক চাপ, ডিপ্রেশন বা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তাই মাকে মানসিকভাবে শক্ত রাখতে পরিবারের সবার সহায়তা প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন মাপার নিয়ম-
- প্রতিবার একই সময়ে (সকালে) ওজন মাপুন
- হালকা পোশাকে ওজন করুন
- সপ্তাহে অন্তত একবার ওজন নিন
- ওজনের গ্রাফ নোট করুন
গর্ভাবস্থায় ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার সাপ্তাহিক চার্ট-
সপ্তাহ | ওজন বৃদ্ধির গড় হার |
---|---|
১-১২ | ১-২ কেজি |
১৩-২০ | প্রতি সপ্তাহে ০.৩-০.৪ কেজি |
২১-৩০ | প্রতি সপ্তাহে ০.৪-০.৫ কেজি |
৩১-৪০ | প্রতি সপ্তাহে ০.৫ কেজি |
প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় কত কেজি ওজন বাড়া স্বাভাবিক?
উত্তর: গড়ে ১০-১৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বাড়া স্বাভাবিক। তবে এটি মায়ের BMI অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।
প্রশ্ন ২: ওজন না বাড়লে কী করবো?
উত্তর: পুষ্টিকর খাবার, দুধ, ডিম ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য বেশি খাবেন। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
প্রশ্ন ৩: অতিরিক্ত ওজন হলে কি শিশুর ক্ষতি হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, শিশুর জন্মের সময় বড় আকার হতে পারে, প্রসবে জটিলতা ও সিজারিয়ানের ঝুঁকি বাড়ে।
প্রশ্ন ৪: ব্যায়াম করলে কি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়?
উত্তর: অবশ্যই, তবে কেবল ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম করবেন।
প্রশ্ন ৫: প্রতিদিন ওজন মাপা দরকার কি?
উত্তর: না, সপ্তাহে একবার ওজন মাপা যথেষ্ট।