গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস: কারণ, লক্ষণ, ঝুঁকি ও প্রতিরোধ

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস: ভূমিকা-

গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো ভ্রূণের সুস্থতা বজায় রাখা। এ সময়কার যে কোনো সংক্রমণ মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি সংক্রমণ হলো গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস। রুবেলা সাধারণত হালকা এক ধরনের ভাইরাসজনিত রোগ হলেও গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। এই সংক্রমণ শিশুর জন্মগত ত্রুটি, গর্ভপাত বা এমনকি মৃতভ্রূণ জন্মের কারণ হতে পারে।

রুবেলা ভাইরাস কি?-

রুবেলা ভাইরাস হলো একটি সংক্রামক ভাইরাস, যাকে অনেক সময় জার্মান মিজলস বা থ্রি-ডে মিজলস বলা হয়। এটি সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায় এবং সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এটি শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে গর্ভবতী মায়েদের জন্য এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়?-

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস ছড়ায় মূলত নিচের উপায়ে:

  • সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে।
  • একই ঘরে দীর্ঘ সময় অবস্থান করার ফলে বাতাসে ছড়ানো ড্রপলেট থেকে।
  • আক্রান্ত মায়ের শরীরে প্রবেশ করলে তা প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে চলে যায়।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের লক্ষণ-

সাধারণত রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর হালকা জ্বর এবং ত্বকে ছোট ছোট লালচে দাগ দেখা যায়। তবে গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের লক্ষণগুলো হলো:

  • হালকা থেকে মাঝারি জ্বর
  • গলায় ব্যথা বা ফোলা
  • ছোট ছোট লালচে ফুসকুড়ি
  • মাথাব্যথা ও অবসাদ
  • চোখে প্রদাহ বা কনজাংটিভাইটিস
  • ক্ষুধামন্দা

অনেক সময় লক্ষণগুলো এতটাই হালকা হয় যে রোগী নিজেও বুঝতে পারেন না তিনি রুবেলায় আক্রান্ত। তবে গর্ভবতী মায়ের জন্য এটি ভয়াবহ ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের ঝুঁকি-

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সবচেয়ে বড় যে ঝুঁকি তৈরি করে তা হলো Congenital Rubella Syndrome (CRS)। এটি ভ্রূণের জন্মগত সমস্যার একটি গুরুতর অবস্থা।

সম্ভাব্য ঝুঁকি:

  • গর্ভপাতের সম্ভাবনা
  • মৃতভ্রূণ জন্ম
  • শিশুর জন্মগত হৃদরোগ
  • শিশুর দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির সমস্যা
  • মানসিক বিকাশে বিলম্ব
  • হাড় ও স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা

বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে যদি মা রুবেলায় আক্রান্ত হন, তবে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি প্রায় ৮০% পর্যন্ত থাকে।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস নির্ণয়-

পরীক্ষার পদ্ধতি:
১. রক্ত পরীক্ষা: 

রুবেলা নির্ণয়ের জন্য রক্তে রুবেলা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয়। 

২. IgM ও IgG অ্যান্টিবডি পরীক্ষা:
  • IgM: এই অ্যান্টিবডি সাম্প্রতিক বা সক্রিয় সংক্রমণ নির্দেশ করে। 
  • IgG: এই অ্যান্টিবডি অতীত সংক্রমণ বা টিকা নেওয়ার মাধ্যমে তৈরি হওয়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্দেশ করে। 
৩. ভাইরাস কালচার: 
কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস কালচারও করা যেতে পারে। 
কেন এই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ?:
১. প্রসবপূর্ব স্ক্রীনিং: 

গর্ভাবস্থার আগে বা চলাকালীন এই পরীক্ষা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে গর্ভবতী রুবেলা থেকে সুরক্ষিত কিনা। 

২. ভ্রূণের সংক্রমণ রোধ: 

যদি রুবেলা না থাকে বা সংক্রমণ হয়, তবে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যা ভ্রূণে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। 

৩. জন্মগত রুবেলা সিন্ড্রোম (CRS) প্রতিরোধ: 
গর্ভাবস্থায় রুবেলা সংক্রমণ হলে শিশুর বিভিন্ন জন্মগত জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন বধিরতা, ছানি, হৃদরোগ, বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা, যা CRS নামে পরিচিত। এই পরীক্ষা CRS প্রতিরোধে সাহায্য করে। 

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের চিকিৎসা-

দুঃখজনকভাবে, রুবেলা ভাইরাসের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। মূলত লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয় যেমন— জ্বর কমানোর ওষুধ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত পানি পান। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংক্রমণ প্রতিরোধ।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস প্রতিরোধ-

রুবেলা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা গ্রহণ।

  • MMR ভ্যাকসিন (Measles, Mumps, Rubella) হলো সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধক ব্যবস্থা।
  • গর্ভাবস্থায় এই টিকা দেওয়া যায় না, তবে গর্ভধারণের আগে অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত।
  • টিকা নেওয়ার অন্তত এক মাস পর গর্ভধারণের পরিকল্পনা করা উচিত।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার উপায়-

  • গর্ভধারণের আগে MMR টিকা নেওয়া।
  • সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
  • ভিড় জায়গায় মাস্ক ব্যবহার করা।
  • নিয়মিত হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার করা।
  • পারিবারিক টিকাদান নিশ্চিত করা, বিশেষ করে শিশুদের।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা-

অনেক মা রুবেলার ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন না। তাই বিয়ের আগে বা গর্ভধারণের পরিকল্পনার সময় রক্ত পরীক্ষা করে রুবেলার টিকার ইতিহাস নিশ্চিত করা জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণ করলে মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব।

উপসংহার-

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা মা ও ভ্রূণ উভয়ের জন্য মারাত্মক হতে পারে। তবে সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণ এবং সচেতনতা থাকলে এই সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই প্রত্যেক গর্ভবতী নারী বা গর্ভধারণের পরিকল্পনাকারী মায়ের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় টিকা গ্রহণ ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া।

গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সম্পর্কিত প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস কতটা ভয়ংকর?
উত্তর: এটি ভয়াবহ কারণ এটি ভ্রূণের জন্মগত ত্রুটি, গর্ভপাত বা মৃতভ্রূণের ঝুঁকি তৈরি করে।

প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় রুবেলা হলে কি চিকিৎসা সম্ভব?
উত্তর: রুবেলার নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। শুধুমাত্র লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় কি রুবেলা ভ্যাকসিন নেওয়া যায়?
উত্তর: না, গর্ভাবস্থায় ভ্যাকসিন দেওয়া নিষেধ। তবে গর্ভধারণের আগে অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন ৪: Congenital Rubella Syndrome (CRS) কী?
উত্তর: CRS হলো শিশুর জন্মগত ত্রুটি যা মায়ের শরীরে গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে।

প্রশ্ন ৫: রুবেলা প্রতিরোধের উপায় কী?
উত্তর: MMR ভ্যাকসিন গ্রহণ, সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top