গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস: পরিচিতি-
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় মা ও অনাগত শিশুর সুস্থতা রক্ষায় সামান্য অসতর্কতাও বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এমনই একটি মারাত্মক সংক্রমণ হলো গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস। যদিও সাধারণ অবস্থায় রুবেলা খুব গুরুতর নয়, তবে গর্ভাবস্থায় এটি ভ্রূণের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস কী-
রুবেলা ভাইরাসকে অনেক সময় “জার্মান মিজলস” বা “থ্রি-ডে মিজলস” বলা হয়। এটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায় এবং হালকা জ্বর, ত্বকে লাল ফুসকুড়ি, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ তৈরি করে। গর্ভবতী নারী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা সরাসরি প্লাসেন্টার মাধ্যমে ভ্রূণের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে জন্মগত ত্রুটি এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের কারণ-
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস মূলত সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র লালার ফোঁটার মাধ্যমে ছড়ায়।
- আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি সংস্পর্শ
- ভাইরাস বহনকারী বস্তু যেমন তোয়ালে, খেলনা বা কাপড় ব্যবহার
- জনসমাগমপূর্ণ স্থানে দীর্ঘ সময় থাকা
যদি একজন নারী রুবেলার টিকা না নিয়ে গর্ভাবস্থায় আক্রান্ত হন, তবে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের লক্ষণ-
রুবেলার উপসর্গ সাধারণত সংক্রমণের ১৪–২১ দিন পর দেখা দেয়। এগুলো অনেক সময় সাধারণ ভাইরাসজনিত অসুস্থতার মতো মনে হতে পারে।
- হালকা থেকে মাঝারি জ্বর
- ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি (মুখ থেকে শুরু হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে)
- গলা ব্যথা ও গলায় লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
- মাথাব্যথা ও চোখ লাল হওয়া
- হালকা কাশি
- অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
গর্ভাবস্থায় এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারকে জানানো জরুরি।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের ঝুঁকি-
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ভ্রূণের ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব।
- গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসব
- Congenital Rubella Syndrome (CRS)
- শিশুর হৃদরোগ
- বধিরতা
- চোখের সমস্যা (ক্যাটারাক্ট, গ্লুকোমা)
- মস্তিষ্কের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
- বিকলাঙ্গতা
বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে রুবেলায় আক্রান্ত হলে ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
Congenital Rubella Syndrome (CRS)-
যখন গর্ভবতী মা রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তখন শিশুর মধ্যে জন্মগত ত্রুটির সৃষ্টি হয়, যা CRS নামে পরিচিত। CRS আক্রান্ত শিশুর মধ্যে সাধারণত নিম্নলিখিত সমস্যা দেখা যায়:
- শ্রবণশক্তি হ্রাস বা বধিরতা
- হৃদপিণ্ডের জটিলতা
- চোখের অস্বাভাবিকতা
- মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের জটিলতা-
রুবেলা ভাইরাসকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়। কারণ এটি শুধু মায়ের জন্যই নয়, সন্তানের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
- গর্ভকালীন জটিলতা বৃদ্ধি
- প্লাসেন্টার ক্ষতি
- শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
- জন্মের পর দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের নির্ণয়-
রুবেলা নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করেন।
- IgM অ্যান্টিবডি টেস্ট: সাম্প্রতিক সংক্রমণ আছে কি না তা বোঝা যায়।
- IgG অ্যান্টিবডি টেস্ট: আগে রুবেলা হয়েছিল কি না বা টিকা নেওয়া হয়েছে কি না বোঝা যায়।
- গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা বোঝার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রামও করা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসের চিকিৎসা-
রুবেলা ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসা মূলত উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মা ও ভ্রূণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করে।
- বিশ্রাম নেওয়া
- পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ
- জ্বর কমানোর ওষুধ (ডাক্তারের পরামর্শে)
- গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা
যদি ভ্রূণ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাহলে ডাক্তার বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন এবং কিছু ক্ষেত্রে গর্ভধারণের জটিলতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস প্রতিরোধ-
রুবেলা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা গ্রহণ।
- গর্ভধারণের অন্তত ১ মাস আগে রুবেলা টিকা নেওয়া উচিত।
- গর্ভাবস্থায় টিকা দেওয়া যায় না।
- যেসব নারী বিয়ের আগে বা সন্তান নেওয়ার আগে টিকা নেননি, তাদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত।
- গর্ভবতী মাকে রুবেলা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
- জনসমাগম এড়িয়ে চলা ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি।
রুবেলা ভ্যাকসিন সম্পর্কিত তথ্য-
রুবেলা প্রতিরোধের জন্য সাধারণত MMR (Measles, Mumps, Rubella) ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
- শিশুদের প্রথম ডোজ ৯ মাস বা ১২ মাস বয়সে দেওয়া হয়।
- দ্বিতীয় ডোজ সাধারণত ১৫–১৮ মাসে দেওয়া হয়।
- প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের সন্তান নেওয়ার আগে এই ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস নিয়ে সচেতনতা-
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস এড়াতে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি নারীর উচিত টিকা নেওয়ার রেকর্ড যাচাই করা। চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, ভ্রমণ বা জনসমাগমের আগে সতর্ক হওয়া, এবং গর্ভাবস্থায় যেকোনো ফুসকুড়ি বা জ্বরকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া জরুরি।
গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস সম্পর্কিত প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় রুবেলা ভাইরাস হলে শিশুর জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি হয়?
উত্তর: বিশেষ করে প্রথম ১২ সপ্তাহে রুবেলা হলে শিশুর Congenital Rubella Syndrome হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
প্রশ্ন ২: গর্ভবতী মায়ের রুবেলা হলে কি চিকিৎসা সম্ভব?
উত্তর: নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। মূলত উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ, ভ্রূণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় কি রুবেলা টিকা নেওয়া যায়?
উত্তর: না, গর্ভাবস্থায় রুবেলা টিকা দেওয়া নিষেধ। টিকা গর্ভধারণের আগে নিতে হয়।
প্রশ্ন ৪: রুবেলা ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় কী?
উত্তর: সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকা গ্রহণ এবং সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
প্রশ্ন ৫: রুবেলা হলে কি গর্ভপাত হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে রুবেলা হলে গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি বাড়ে।