গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট: কারণ, ঝুঁকি, প্রতিকার ও করণীয়

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট কী?-

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট বা ডিসপনিয়া হলো এক অবস্থা যেখানে গর্ভবতী নারী স্বাভাবিকের তুলনায় কম অক্সিজেন পাচ্ছেন বলে অনুভব করেন। এটি মূলত শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা বুক ভারী লাগার মতো অনুভূতি। অনেক সময় হাঁটা, কাজ করা বা শোওয়ার সময় এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

গর্ভাবস্থার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্বাসকষ্ট ভিন্ন ভিন্ন কারণে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক পরিবর্তনের অংশ, আবার কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিলতার লক্ষণ হতে পারে।

কেন গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট হয়?-

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট হওয়ার পেছনে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ও স্বাস্থ্যজনিত কারণ থাকে। এর মধ্যে প্রধানগুলো হলো—

  • হরমোন পরিবর্তন: প্রজেস্টেরন হরমোন বাড়ার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়।
  • বর্ধিত জরায়ুর চাপ: গর্ভের ভ্রূণ বড় হতে থাকলে জরায়ু ডায়াফ্রামকে চাপ দেয়, ফলে ফুসফুস পুরোপুরি প্রসারিত হতে পারে না।
  • অক্সিজেনের চাহিদা বৃদ্ধি: শিশুর বৃদ্ধি ও মায়ের শরীরের জন্য বেশি অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।
  • রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি: গর্ভাবস্থায় রক্তের পরিমাণ ৩০-৫০% পর্যন্ত বেড়ে যায়, ফলে হার্ট ও ফুসফুসে বাড়তি চাপ পড়ে।
  • অ্যানিমিয়া (রক্তশূন্যতা): আয়রনের ঘাটতি থাকলে শরীরে অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়, ফলে শ্বাসকষ্ট বাড়ে।
  • অ্যাজমা বা অন্যান্য শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগের ইতিহাস।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্টের সময়কাল-

  • প্রথম ত্রৈমাসিক (১-৩ মাস): হরমোন পরিবর্তনের কারণে শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে।
  • দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (৪-৬ মাস): শরীরের অক্সিজেন চাহিদা বাড়ায় শ্বাসকষ্ট বাড়তে পারে।
  • তৃতীয় ত্রৈমাসিক (৭-৯ মাস): জরায়ুর আকার বড় হয়ে ফুসফুসে চাপ পড়ে, ফলে শ্বাসকষ্ট সবচেয়ে বেশি হয়।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্টের লক্ষণ-

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • বুক ভারী লাগা
  • হাঁটা বা কাজ করার সময় শ্বাস ছোট হয়ে যাওয়া
  • সিঁড়ি ওঠার সময় দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া
  • শোয়ার সময় শ্বাস আটকে আসা

কখন শ্বাসকষ্ট বিপজ্জনক হতে পারে?-

সব শ্বাসকষ্টই স্বাভাবিক নয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিলতার ইঙ্গিত হতে পারে। যেমন—

  • বুকের ব্যথা হওয়া
  • ঠোঁট বা আঙুল নীল হয়ে যাওয়া
  • অতিরিক্ত মাথা ঘোরা
  • শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হওয়া
  • কাশি বা রক্ত মিশ্রিত কফ আসা

এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি-

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট অনেক সময় শুধুমাত্র অস্বস্তি সৃষ্টি করে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিলতা ডেকে আনতে পারে।

মায়ের ঝুঁকি:

  • ঘুমের ব্যাঘাত
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি
  • উদ্বেগ ও মানসিক চাপ
  • হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগ থাকলে ঝুঁকি বৃদ্ধি

শিশুর ঝুঁকি:

  • মায়ের শরীরে অক্সিজেনের অভাব হলে শিশুরও অক্সিজেন সরবরাহ কমে যেতে পারে।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে শিশুর বৃদ্ধিতে সমস্যা হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট প্রতিকার-

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট কমাতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—

  • সোজা হয়ে বসা ও শোয়া: বালিশ ব্যবহার করে আধশোয়া অবস্থায় ঘুমানো।
  • শ্বাস ব্যায়াম: ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নেওয়া।
  • হালকা ব্যায়াম ও হাঁটা: শরীর সক্রিয় রাখলে ফুসফুস ভালোভাবে কাজ করে।
  • সুষম খাদ্য গ্রহণ: আয়রন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া।
  • পর্যাপ্ত পানি পান।
  • ভারী কাজ এড়িয়ে চলা।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ-

  • গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই নিয়মিত চেকআপ করা।
  • আয়রন সাপ্লিমেন্ট ও সুষম খাবার গ্রহণ।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • ধূমপান, ধুলাবালি ও দূষণ এড়িয়ে চলা।
  • নিয়মিত হালকা ব্যায়াম ও যোগব্যায়াম করা।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন-

শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য গর্ভবতী মায়েদের কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন—

  • দৈনিক ঘুমের সময় বৃদ্ধি করা।
  • আরামদায়ক পোশাক পরা।
  • ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা।
  • স্ট্রেস কমাতে মেডিটেশন বা প্রার্থনা করা।

বাংলাদেশে গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্টের প্রেক্ষাপট-

বাংলাদেশে গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট একটি সাধারণ সমস্যা। অনেক সময় এটি অ্যানিমিয়া ও পুষ্টির ঘাটতির কারণে বেড়ে যায়। গ্রামীণ এলাকায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক নারী এ সমস্যায় ভোগেন।  অনেক সময় তা গর্ভবতী নারী ও অনাগত সন্তানের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে।  সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

উপসংহার-

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট অনেকাংশে স্বাভাবিক হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিল সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই প্রতিটি হবু মায়ের উচিত শ্বাসকষ্টকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। সঠিক পুষ্টি, বিশ্রাম ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট সম্পর্কিত প্রশ্ন-

 গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, হরমোন পরিবর্তন ও জরায়ুর চাপের কারণে অনেক নারী এ সমস্যায় ভোগেন।

 শ্বাসকষ্ট কখন বিপজ্জনক হয়?
যখন বুক ব্যথা, ঠোঁট নীল হওয়া বা প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তখন এটি বিপজ্জনক।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট কমানোর উপায় কী?
সোজা হয়ে বসা, শ্বাস ব্যায়াম, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত বিশ্রাম নেওয়া।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট কি শিশুর ক্ষতি করে?
সাধারণ শ্বাসকষ্ট শিশুর ক্ষতি করে না, তবে গুরুতর হলে অক্সিজেনের ঘাটতি হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করা যায় কি?
হ্যাঁ, নিয়মিত চেকআপ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মেনে চললে অনেকটাই প্রতিরোধ করা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top