জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন: ব্যবহার, সুবিধা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতা

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন: ভূমিকা-

গর্ভনিরোধক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন একটি অত্যন্ত কার্যকরী ও নিরাপদ উপায়। এটি এমন নারীদের জন্য বিশেষ উপযোগী যারা দীর্ঘমেয়াদে গর্ভধারণ এড়াতে চান কিন্তু প্রতিদিন বড়ি খাওয়ার ঝামেলা পোহাতে চান না। জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন হরমোনভিত্তিক একটি পদ্ধতি, যা নারীর শরীরে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমে ডিম্বাণু মুক্ত হওয়া (ovulation) বন্ধ করে দেয়।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন সম্পর্কে—এর ব্যবহার পদ্ধতি, কার্যকারিতা, সুবিধা, অসুবিধা এবং সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। (জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি: ব্যবহার, উপকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও করণীয়)

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন কী?-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন একটি হরমোনাল গর্ভনিরোধক, যেখানে প্রোজেস্টেরন জাতীয় হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এটি সাধারণত ৩ মাস পর পর দেওয়া হয় এবং এই হরমোন জরায়ুর আস্তরণ ও ডিম্বাশয়ের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের ধরন-

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের দুটি ধরন প্রচলিত—

  • ডেপো-প্রোভেরা (Depo-Provera) – এটি ৩ মাস অন্তর প্রয়োগ করতে হয়।
  • নোরিস্টেরাট (Noristerat) – এটি প্রায় ২ মাস পর্যন্ত কার্যকর থাকে।

সাধারণত ডেপো-প্রোভেরা বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন কীভাবে কাজ করে?-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন নারীর শরীরে হরমোন সরবরাহ করে যা—

  • ডিম্বাণু তৈরি ও মুক্ত হওয়া বন্ধ করে।
  • জরায়ুর গ্রীবার শ্লেষ্মা ঘন করে তোলে, ফলে শুক্রাণু জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না।
  • জরায়ুর আস্তরণ পাতলা করে, যাতে নিষিক্ত ডিম্বাণু স্থাপন হতে না পারে।

ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা ৯৯% পর্যন্ত কমে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের ব্যবহার পদ্ধতি-

  • জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন সাধারণত পেশীতে (intramuscular) দেওয়া হয়।
  • মাসিক চক্রের প্রথম ৫ দিনের মধ্যে ইনজেকশন নিলে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়।
  • যদি মাসিকের অন্য সময়ে নেওয়া হয়, তবে ৭ দিন পর্যন্ত অন্য কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়।
  • প্রতি ১২ সপ্তাহ (৩ মাস) পর পর নিয়মিত ইনজেকশন নিতে হয়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের কার্যকারিতা-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন অত্যন্ত কার্যকর। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি প্রায় ৯৯% কার্যকর। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে মাত্র ১ জন অনিচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী হতে পারেন।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের সুবিধা-

  • খুবই কার্যকরী: সঠিকভাবে ব্যবহার করলে প্রায় ৯৯% কার্যকর।
  • দীর্ঘস্থায়ী: ৩ মাস পর্যন্ত কার্যকর থাকে, প্রতিদিন বড়ি খাওয়ার প্রয়োজন নেই।
  • গোপনীয়তা বজায় থাকে: বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে কেউ জন্মনিয়ন্ত্রন ব্যবহার করছেন।
  • স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য উপযোগী: সন্তান জন্মের ৬ সপ্তাহ পর থেকে ব্যবহার করা যায়।
  • মাসিক কমাতে সাহায্য করে: কিছু নারীর মাসিক হালকা হয়ে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়, যা রক্তশূন্যতা কমাতে সাহায্য করে।
  • জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়: গবেষণায় দেখা গেছে এটি জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের অসুবিধা-

  • নিয়মিত নিতে হবে: প্রতি ৩ মাস অন্তর ইনজেকশন নিতে ভুলে গেলে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  • মাসিকের পরিবর্তন: অনেকের মাসিক অনিয়মিত বা দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
  • ফের প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসতে সময় লাগে: ইনজেকশন বন্ধ করার পর আবার গর্ভধারণে সময় লাগতে পারে (৬-১২ মাস)।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে: ওজন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা, হাড় ক্ষয়, মেজাজ খিটখিটে হওয়া ইত্যাদি।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া-

যদিও সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে দেখা যায় না, তবে সাধারণত কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে—

  • মাসিক অনিয়মিত হওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • ওজন বৃদ্ধি।
  • মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা।
  • স্তনে ব্যথা বা অস্বস্তি।
  • মেজাজের পরিবর্তন বা ডিপ্রেশন।
  • হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া (দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে)।

তবে অনেক সময় এগুলো কয়েক মাস পর স্বাভাবিক হয়ে যায়।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন কারা ব্যবহার করতে পারবেন না?-

কিছু ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন ব্যবহার না করাই ভালো। যেমন—

  • গর্ভবতী নারী।
  • হাড় ক্ষয়ের সমস্যা বা অস্টিওপোরোসিস আছে এমন নারী।
  • অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস রোগী।
  • যাদের স্তন ক্যান্সার আছে বা আগে ছিল।
  • যাদের রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা আছে।

এ কারণে জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন ও ভবিষ্যৎ প্রজনন-

অনেক নারী ভাবেন জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন নিলে হয়তো চিরদিনের জন্য সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল। ইনজেকশন বন্ধ করার পর প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে। তবে অন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির তুলনায় গর্ভধারণে কিছুটা দেরি হতে পারে।

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন বনাম জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি-

বিষয় জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি
ব্যবহার পদ্ধতি ৩ মাস অন্তর ইনজেকশন প্রতিদিন বড়ি খেতে হয়
কার্যকারিতা প্রায় ৯৯% প্রায় ৯৫-৯৯%
সুবিধা ঝামেলাহীন, গোপনীয় সহজলভ্য, সস্তা
অসুবিধা নিয়মিত ইনজেকশন নিতে হয়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিদিন খেতে হয়, ভুলে গেলে কার্যকারিতা কমে যায়

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন নেওয়ার সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি-

  • নির্ধারিত সময় মেনে ইনজেকশন নিতে হবে।
  • ইনজেকশন নেওয়ার সময় চিকিৎসকের কাছে আপনার শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে জানাতে হবে।
  • দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ভালো।
  • হাড়ের ঘনত্ব কমার ঝুঁকি থাকায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত।

উপসংহার-

জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন হলো একটি নিরাপদ, কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী গর্ভনিরোধক পদ্ধতি। যারা প্রতিদিন বড়ি খাওয়ার ঝামেলা এড়াতে চান এবং গোপনীয়ভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার উপায়। তবে যেকোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মতো এটিতেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। তাই ব্যবহার শুরুর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন কতটা কার্যকর?
উত্তর: জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন সঠিকভাবে ব্যবহার করলে প্রায় ৯৯% কার্যকর।

প্রশ্ন ২: জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী?
উত্তর: মাসিক অনিয়মিত হওয়া, ওজন বৃদ্ধি, মাথাব্যথা, হাড় ক্ষয়, মেজাজ খিটখিটে হওয়া ইত্যাদি সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

প্রশ্ন ৩: জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন নেওয়া কি স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য নিরাপদ?
উত্তর: হ্যাঁ, সন্তান জন্মের ৬ সপ্তাহ পর থেকে স্তন্যদায়ী মায়েরা নিরাপদে এটি ব্যবহার করতে পারেন।

প্রশ্ন ৪: জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন বন্ধ করলে কি গর্ভধারণ সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে সাধারণত ৬-১২ মাসের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা ফিরে আসে।

প্রশ্ন ৫: জন্মনিয়ন্ত্রন ইনজেকশন কি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়?
উত্তর: না, বরং কিছু ক্ষেত্রে এটি জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top