ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা: ভূমিকা-
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনে আনন্দময় সময় হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা জটিল হয়ে ওঠে। যখন গর্ভাবস্থায় মায়ের বা শিশুর জীবন ও স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ে, তখন তাকে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে মা ও ভ্রূণ উভয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণ হলো অবহেলিত বা সঠিকভাবে পরিচর্যা না করা ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা। এই ব্লগে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা কী?-
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা (High Risk Pregnancy) হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে মা বা ভ্রূণকে গর্ভাবস্থার সময় বিশেষ চিকিৎসা সেবা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়। এই অবস্থায় সামান্য অবহেলাও মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ হতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার কারণ-
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার জন্য একাধিক কারণ দায়ী হতে পারে। এগুলোকে প্রধানত শারীরিক, বয়সজনিত, জীবনযাত্রা সম্পর্কিত ও চিকিৎসাগত ইতিহাস ভিত্তিতে ভাগ করা যায়।
১. বয়সজনিত কারণ
- ১৮ বছরের কম বয়সে গর্ভধারণ
- ৩৫ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ
২. শারীরিক ও দীর্ঘমেয়াদী রোগ
- উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension)
- ডায়াবেটিস (Gestational বা পূর্ব থেকে থাকা)
- হৃদরোগ
- কিডনি সমস্যা
- থাইরয়েড রোগ
৩. গর্ভাবস্থাজনিত জটিলতা
- গর্ভপাত বা মৃতভ্রূণের পূর্ব ইতিহাস
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও এক্লাম্পসিয়া
- প্লাসেন্টার সমস্যা (Placenta previa বা Placental abruption)
- অকাল প্রসব (Preterm labor)
৪. বহুগর্ভধারণ (Multiple pregnancy)
যমজ বা ত্রৈমাসিক শিশু থাকলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
৫. জীবনযাত্রা ও পরিবেশ
- ধূমপান, অ্যালকোহল বা মাদক সেবন
- অপুষ্টি বা অতিরিক্ত ওজন
- মানসিক চাপ
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার সাধারণ লক্ষণ-
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় কিছু প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা অবহেলা করা উচিত নয়।
- ঘন ঘন মাথাব্যথা
- চোখে ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টি সমস্যার উদ্ভব
- অস্বাভাবিক ক্লান্তি
- অতিরিক্ত বমি বা বমি বমি ভাব
- শ্বাসকষ্ট
- হাত-পা ও মুখে অস্বাভাবিক ফোলাভাব
গুরুতর লক্ষণ যেগুলো উপেক্ষা করা বিপজ্জনক-
- তীব্র পেটব্যথা
- যোনি দিয়ে রক্তপাত
- শিশুর নড়াচড়া হঠাৎ কমে যাওয়া
- বুক ধড়ফড় ও মাথা ঘোরা
- উচ্চ রক্তচাপের হঠাৎ বৃদ্ধি
- খিঁচুনি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
এসব ক্ষেত্রে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার স্বাস্থ্যঝুঁকি-
মায়ের জন্য ঝুঁকি:
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
- অকাল প্রসব
- সংক্রমণ
- উচ্চ রক্তচাপ ও খিঁচুনি
- মৃত্যুর ঝুঁকি
শিশুর জন্য ঝুঁকি:
- কম ওজন নিয়ে জন্ম
- অকালে জন্ম
- জন্মগত ত্রুটি
- মৃতভ্রূণ
- নবজাতক মৃত্যুহার বৃদ্ধি
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় করণীয়-
১. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
প্রতিটি ট্রাইমেস্টারে ডাক্তারের চেকআপ ও আলট্রাসাউন্ড করাতে হবে।
২. সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন
আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
অতিরিক্ত ওজন মা ও শিশুর উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৪. বিশ্রাম নিন
যথেষ্ট বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
৫. মানসিক চাপ কমান
ধ্যান, বই পড়া বা হালকা সংগীত শোনা উপকারী।
৬. খারাপ অভ্যাস এড়িয়ে চলুন
ধূমপান, অ্যালকোহল ও মাদক সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
৭. জরুরি প্রস্তুতি নিন
প্রসবের হাসপাতাল, জরুরি যোগাযোগ নম্বর ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী আগে থেকেই প্রস্তুত রাখুন।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার প্রতিরোধ-
- গর্ভধারণের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
- সঠিক সময়ে গর্ভধারণ করা (১৮-৩০ বছর বয়সে সবচেয়ে নিরাপদ)।
- নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর সক্রিয় রাখা।
- রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ না খাওয়া।
- পারিবারিক রোগের ইতিহাস থাকলে আগে থেকেই জানানো।
ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা নিয়ে সাধারণ জিজ্ঞাসা-
প্রশ্ন ১: ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা কাকে বলে?
উত্তর: যখন গর্ভাবস্থায় মা বা শিশুর জীবন ও স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর ঝুঁকি তৈরি হয়, তখন তাকে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা বলা হয়।
প্রশ্ন ২: ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা হলে কি স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব?
উত্তর: অনেক সময় সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিজারিয়ান প্রয়োজন হতে পারে। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে জটিলতার ধরন ও চিকিৎসকের পরামর্শের ওপর।
প্রশ্ন ৩: বয়স কি ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার একটি কারণ?
উত্তর: হ্যাঁ, ১৮ বছরের নিচে ও ৩৫ বছরের বেশি বয়সে গর্ভধারণ ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রশ্ন ৪: ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করা যায় কি?
উত্তর: হালকা ব্যায়াম বা হাঁটা করা যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।
প্রশ্ন ৫: কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর: সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত চেকআপ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে ঝুঁকি অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।