ট্রান্সভার্স লাই: গর্ভাবস্থায় ঝুঁকি, কারণ, উপসর্গ ও সমাধান

ট্রান্সভার্স লাই: পরিচিতি-

গর্ভাবস্থার শেষের দিকে যখন শিশুর জন্মের সময় ঘনিয়ে আসে, তখন শিশুর অবস্থান (fetal position) মায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত শিশুর মাথা নিচের দিকে থাকে, যাকে cephalic presentation বলা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুটি গর্ভের ভেতরে আড়াআড়িভাবে শুয়ে থাকে। এই অবস্থাকেই ট্রান্সভার্স লাই বলা হয়। ট্রান্সভার্স লাই অবস্থায় স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকি বাড়তে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন হয়।

(গর্ভাবস্থায় অ্যানোমালি স্ক্যান: প্রয়োজন, সময়সূচি, উপকারিতা ও প্রস্তুতি)

ট্রান্সভার্স লাই কী-

ট্রান্সভার্স লাই হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে ভ্রূণ মায়ের জরায়ুর মধ্যে লম্বালম্বি না হয়ে আড়াআড়ি (crosswise) অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ, শিশুর মাথা ও পা দুটোই মায়ের দুই পাশে থাকে, এবং পিঠ থাকে জরায়ুর একদিকে।ট্রান্সভার্স লাই এর ধরন-

ট্রান্সভার্স লাই এরও কিছু ভিন্ন ধরন রয়েছে, যেমন:

  • Head on one side – শিশুর মাথা মায়ের এক পাশে থাকে।
  • Back up transverse – শিশুর পিঠ উপরের দিকে থাকে।
  • Back down transverse – শিশুর পিঠ নিচের দিকে থাকে।

প্রতিটি ধরনের অবস্থাই জটিল হতে পারে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

ট্রান্সভার্স লাই এর কারণ-

ট্রান্সভার্স লাই হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যেমন:

  • মায়ের জরায়ুর আকার বা আকৃতির অস্বাভাবিকতা
  • বহুগর্ভধারণ (যমজ বা একাধিক সন্তান)
  • অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডের অতিরিক্ত উপস্থিতি (Polyhydramnios)
  • প্লাসেন্টার অস্বাভাবিক অবস্থান (placenta previa)
  • শিশুর আকার ছোট হলে বেশি নড়াচড়া করার সুযোগ পাওয়া
  • পূর্বে একাধিক সিজারিয়ান ডেলিভারি হওয়া
  • জরায়ুর পেশির দুর্বলতা

ট্রান্সভার্স লাই এর উপসর্গ-

গর্ভাবস্থার শেষের দিকে শিশুর অবস্থান বোঝা যায় চিকিৎসকের আলট্রাসনোগ্রাফি বা শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে। তবে কিছু উপসর্গ মায়ের কাছেও অনুভূত হতে পারে, যা থেকে ট্রান্সভার্স লাই এর সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এগুলো হলো:

  • শিশুর নড়াচড়া একপাশে বেশি অনুভূত হওয়া – আড়াআড়িভাবে থাকলে শিশুর নড়াচড়া একদিকে বেশি টের পাওয়া যায়।

  • পেটের আকার চওড়া হওয়া – স্বাভাবিক অবস্থায় পেট লম্বালম্বি থাকে, কিন্তু ট্রান্সভার্স লাই হলে পেট অনেকটা আড়াআড়ি বা চওড়া মনে হয়।

  • শিশুর মাথা নিচে না নামা – গর্ভের শেষ মাসগুলোতে সাধারণত শিশুর মাথা নিচে নামে, কিন্তু ট্রান্সভার্স লাই হলে তা হয় না।

  • শিশুর মাথা বা নিতম্ব নিচে টের না পাওয়া – ডাক্তার বা মা কেউই নিচের দিকে শক্ত মাথা বা নিতম্ব অনুভব করেন না।

  • আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে আড়াআড়ি অবস্থান ধরা পড়া – এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপসর্গ।

ট্রান্সভার্স লাই এর ঝুঁকি-

ট্রান্সভার্স লাই অবস্থায় মা ও শিশুর জন্য বেশ কিছু ঝুঁকি তৈরি হতে পারে:

  • স্বাভাবিক প্রসব অসম্ভব হয়ে ওঠে
  • জরুরি সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে
  • আমবিলিকাল কর্ড প্রসবপথে আগে চলে আসতে পারে (cord prolapse), যা প্রাণঘাতী হতে পারে
  • প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি
  • শিশুর শ্বাসকষ্ট ও জটিলতার ঝুঁকি

ট্রান্সভার্স লাই এর নির্ণয়-

ট্রান্সভার্স লাই সাধারণত চিকিৎসক নিচের উপায়ে নির্ণয় করেন:

  • শারীরিক পরীক্ষা (Leopold’s maneuvers)
  • আলট্রাসনোগ্রাফি (USG)

আলট্রাসনোগ্রাফি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়, যা শিশুর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়।

ট্রান্সভার্স লাই এর চিকিৎসা-

ট্রান্সভার্স লাই নিরাময়ের জন্য সাধারণত কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়:

  • External Cephalic Version (ECV):
    গর্ভাবস্থার ৩৬-৩৭ সপ্তাহে চিকিৎসক বিশেষ কৌশলে শিশুকে ঘুরিয়ে মাথা নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। তবে এটি সব ক্ষেত্রে সফল হয় না।
  • সিজারিয়ান ডেলিভারি:
    যদি শিশুর অবস্থান পরিবর্তন না হয়, তবে নিরাপত্তার জন্য সিজারিয়ান ডেলিভারি সবচেয়ে কার্যকর সমাধান।

ট্রান্সভার্স লাই এ মায়ের করণীয়-

  • নিয়মিত ডাক্তারকে দেখাতে হবে
  • আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে
  • শিশুর নড়াচড়ার ধরণ লক্ষ্য করতে হবে
  • কোনো অস্বাভাবিকতা বা ব্যথা হলে দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে

ট্রান্সভার্স লাই প্রতিরোধের উপায়-

যদিও ট্রান্সভার্স লাই প্রতিরোধ করা সব সময় সম্ভব নয়, তবে কিছু সতর্কতা ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে:

  • গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
  • গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • নির্ধারিত সময়ে আলট্রাসনোগ্রাফি করানো
  • স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া

উপসংহার-

ট্রান্সভার্স লাই হলো একটি জটিল গর্ভাবস্থার অবস্থা, যা মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবে সময়মতো সঠিক নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজনে সিজারিয়ান ডেলিভারি গ্রহণ করা – এগুলোই নিরাপদ মাতৃত্ব ও শিশুর জীবন বাঁচানোর উপায়।

 

প্রশ্নউত্তর-

প্রশ্ন: ট্রান্সভার্স লাই হলে কি স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব?
উত্তর: না, ট্রান্সভার্স লাই অবস্থায় স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারি করতে হয়।

প্রশ্ন: ট্রান্সভার্স লাই কখন ধরা পড়ে?
উত্তর: গর্ভাবস্থার শেষের দিকে আলট্রাসনোগ্রাফি করলে ট্রান্সভার্স লাই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

প্রশ্ন: ট্রান্সভার্স লাই হলে শিশুর জন্য কতটা ঝুঁকি থাকে?
উত্তর: ট্রান্সভার্স লাই অবস্থায় শিশুর জন্য ঝুঁকি বেশি, বিশেষ করে cord prolapse ও শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি থাকে। তাই সময়মতো চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।

প্রশ্ন: External Cephalic Version (ECV) কি সব ক্ষেত্রে করা যায়?
উত্তর: না, সবার ক্ষেত্রে ECV করা যায় না। প্লাসেন্টা previa বা অন্য জটিলতা থাকলে এটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

প্রশ্ন: ট্রান্সভার্স লাই প্রতিরোধ করা সম্ভব কি?
উত্তর: সব ক্ষেত্রে নয়। তবে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়।

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top