নবজাতকের প্রথম গোসল: একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত-
নবজাতকের জন্ম মানেই একটি নতুন জীবনের সূচনা। এই ছোট্ট শিশুর যত্নের প্রতিটি দিক হতে হয় অত্যন্ত সংবেদনশীল ও সচেতনভাবে পরিচালিত। তার মাঝে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয় হলো — “নবজাতকের কখন প্রথম গোসল করানো উচিত?” এটি শুধুমাত্র পরিচ্ছন্নতার বিষয় নয়, বরং শিশুর স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং ত্বকের সুরক্ষার সাথেও জড়িত।
অনেক সময় নবজাতককে জন্মের ঠিক পরপরই গোসল করিয়ে ফেলা হয়, যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই সময়, পরিবেশ এবং নবজাতকের শারীরিক অবস্থা বুঝে গোসল করানো উচিত। শিশুর ত্বকের জন্য কোন সাবান ব্যবহার করা উচিত?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ কী বলে?-
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং শিশুবিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মের পর কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত নবজাতককে গোসল না করানোই সবচেয়ে ভালো। তারা বলেন, জন্মের সময় শিশুর গায়ে থাকা সাদা স্তর বা ভার্নিক্স কেসিওসা একটি প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ। এটি শিশুর ত্বককে আর্দ্র রাখে, সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
তাই এই স্তরটি যতটা সম্ভব দেরিতে ধুয়ে ফেলা উচিত।
প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোসল না করানোর কারণ-
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞদের মতে, নবজাতকের জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোসল করানো উচিত নয়। কারণ নবজাতকের ত্বকে জন্মের সময় একটি প্রাকৃতিক সাদা স্তর থাকে যাকে বলা হয় ভার্নিক্স কেসিওসা (Vernix Caseosa)। এটি শিশুর ত্বককে সুরক্ষা দেয়, আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। দ্রুত এই স্তরটি ধুয়ে ফেললে শিশুর ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে এবং ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তাহলে নবজাতকের কখন প্রথম গোসল করানো উচিত?-
বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, জন্মের ২৪ ঘণ্টা পর থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতকের প্রথম গোসল করানো সবচেয়ে নিরাপদ। যদি শিশুটি একেবারে সুস্থ থাকে, তাহলে জন্মের ২য় বা ৩য় দিনে প্রথম স্নান করানো যেতে পারে।
তবে যদি শিশুটি প্রিম্যাচিওর (অকাল জন্ম), কম ওজনের অথবা কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তাহলে প্রথম ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত শুধু স্পঞ্জ বাথ বা হালকা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করাই বাঞ্ছনীয়।
- প্রথম গোসলের সময়:
বিশেষজ্ঞরা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) ও আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স বলেন, নবজাতককে প্রথম ২৪ ঘণ্টায় গোসল করানো উচিত নয়। এতে শিশুর শরীরের প্রাকৃতিক ভার্নিক্স কেসিওসা এর যত্ন নষ্ট হয়, যার ফলে ত্বক শুষ্ক ও সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে । - স্পঞ্জ বাথ কেন অপরিহার্য:
নাভিরিয়া না ওঠা পর্যন্ত বা রোম্পচিকিৎসা পর্যন্ত নবজাতকের স্পঞ্জ বাথ দেওয়া উচিত। গোসলের জন্য টব ব্যবহারের আগে শিশুর নাভিপট অকালে ভিজে গেলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে । - নিরাপত্তা ও তাপমাত্রা:
– পানির তাপমাত্রা ৩৭–৩৮°C হওয়া উচিত, যেটা কনুই বা কব্জিতে পরীক্ষা করে নিতে হবে ।
– সবসময় এক হাত শিশুকে ধরে রাখতে হবে। অল্প পানিতেও শিশুর ডুবতে পারে, তাই নির্দিষ্ট নজর দরকার ।
– শিশুকে স্লিপ-প্রুফ পৃষ্ঠায় গোসল করানো বাঞ্ছনীয়, এবং শিল্প–বস্তুযুক্ত বাথ সিট এড়িয়ে চলা উচিত । - ছোট উদ্যোগ, বড় সুবিধা
করণীয় | কারণ |
স্পঞ্জ বাথ প্রথম সপ্তাহে | নাভি রিকভারি পর্যন্ত নিরাপদ বাথ পদ্ধতি |
হালকা সাবান বা শুধুমাত্র পানি | কেমিক্যাল মুক্ত, নরম ত্বক রক্ষায় সহায়তা |
গোসলের পরিবেশ | ঘর উষ্ণ রাখুন (২৫°C), গোসল স্থল নিরোধিত ও নরম হওয়া উচিত |
গোসলের সময় | শরীর ৫–১০ মিনিটের মধ্যে শুকিয়ে নিন, লোশন বা বেবি অয়েল প্রয়োগ করুন |
নবজাতকের প্রথম গোসলের নিয়ম ও প্রস্তুতি-
নবজাতকের প্রথম গোসলকে আরামদায়ক ও নিরাপদ করতে কিছু বিষয় মনে রাখা দরকার:
- ১জল গরমের তাপমাত্রা: হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন (৩৭–৩৮°C)।। খুব গরম বা ঠান্ডা পানি শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
- সময় নির্বাচন: এমন সময় বেছে নিন, যখন নবজাতক খুশি ও শান্ত থাকে।
- সাবান: নবজাতকের জন্য বিশেষ সাবান ব্যবহার করুন। কড়া কেমিক্যালযুক্ত সাবান এড়িয়ে চলুন।
- পরিবেশ: গোসলের জায়গাটি যেন বাতাস চলাচলহীন ও উষ্ণ থাকে।
- গোসলের সময়: গোসল যেন ৫ থেকে ৭ মিনিটের বেশি না হয়।
- গোসলের জিনিসপত্র প্রস্তুত রাখুন: তোয়ালে, নরম সাবান, কটন, শিশুর কাপড় ইত্যাদি।
- পরিবেশ উষ্ণ রাখুন: ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রেখে বাতাস বন্ধ করুন যাতে ঠান্ডা না লাগে।
গোসলের সময় যা করবেন-
- শিশুর মাথা ও ঘাড় সবসময় সাপোর্ট দিয়ে ধরুন
- প্রথমে মুখ, তারপর হাত ও শরীর ধুয়ে নিন
- সাবান ব্যবহার করলে তা যেন খুব মৃদু হয়
- মাথা ধোয়ার সময় খুব সতর্ক হোন
- শিশুকে বেশি সময় ভেজা অবস্থায় রাখবেন না
- গোসলের সময় ৫ থেকে ৭ মিনিট রাখাই যথেষ্ট
গোসলের পরে করণীয়-
- শিশুকে দ্রুত তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে মুছে ফেলুন
- নরম এবং আরামদায়ক কাপড় পরিয়ে দিন
- প্রয়োজনে শিশুর ত্বকে বেবি লোশন বা তেল ব্যবহার করুন
- শিশুকে উষ্ণ পরিবেশে রাখুন যাতে ঠান্ডা না লাগে
- মাথা পুরোপুরি শুকিয়ে নিন
গ্রীষ্ম ও শীতকালে নবজাতকের গোসল কেমন হওয়া উচিত?-
শীতকালে:
শীতকালে নবজাতককে প্রতিদিন গোসল না করিয়ে দিন ফেলে একদিন পরপর করানো যেতে পারে। মাথা না ভেজানোই ভালো। গোসলের সময় পানি একটু বেশি কুসুম গরম হতে হবে এবং সময়ও কম রাখার চেষ্টা করতে হবে।
গ্রীষ্মকালে:
গ্রীষ্মকালে নবজাতক বেশি ঘামে, তাই দিনে একবার করে গোসল করানো যেতে পারে। তবে সাবান ব্যবহার বেশি না করাই ভালো। খুব বেশি গরমে শিশু অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, তাই গোসলের সময়টাও খুব গরমে না করাই ভালো।
নবজাতকের ত্বকের যত্ন-
নবজাতকের ত্বক খুবই কোমল এবং সংবেদনশীল। তাই গোসলের পরে বা গোসল ছাড়াও যত্ন নেওয়া জরুরি:
- সাবান হালকা ও বেবি ফ্রেন্ডলি হতে হবে
- অ্যালকোহল-মুক্ত এবং পারফিউম-মুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন
- হালকা তেল বা বেবি লোশন প্রয়োগ করতে পারেন
- গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশুর শরীর আবৃত রাখুন
উপসংহার-
নবজাতকের কখন প্রথম গোসল করানো উচিত, এটি নির্ভর করে শিশুর স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং জন্মের পরিস্থিতির উপর। শিশুর প্রথম গোসল যেন তার জন্য নিরাপদ হয়—তা নিশ্চিত করতে হবে। জন্মের ২৪ ঘণ্টা পর থেকে ৩ দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রথম গোসল সবচেয়ে উপযুক্ত ধরা হয়।
শিশুর ত্বক ও শরীর যাতে কোনোভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কখনোই শিশুর তাড়াহুড়ো করে গোসল করানো উচিত নয়। পেডিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে যত্নসহকারে গোসল করালেই শিশুর সুস্থ ও আরামদায়ক জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।
প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: নবজাতকের কখন প্রথম গোসল করানো উচিত?
উত্তর: জন্মের অন্তত ২৪ ঘণ্টা পর থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে প্রথম গোসল করানো নিরাপদ।
প্রশ্ন ২: নবজাতককে জন্মের পরপর গোসল করানো কি ক্ষতিকর?
উত্তর: হ্যাঁ, এতে শিশুর ত্বকের প্রাকৃতিক সুরক্ষাকবচ ভার্নিক্স কেসিওসা ধুয়ে যায় যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: নাভি শুকানোর আগে কি গোসল করানো যায়?
উত্তর: না। নাভি না শুকানো পর্যন্ত গোসল না করিয়ে স্পঞ্জ বাথ করানো উচিত।
প্রশ্ন ৪: নবজাতকের গোসলের পানি কতটা গরম হওয়া উচিত?
উত্তর: কুসুম গরম (৩৭–৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। হাতের কব্জি বা কনুই দিয়ে পানি পরীক্ষা করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৫: নবজাতকের জন্য কোন সাবান ব্যবহার করব?
উত্তর: পারফিউম-মুক্ত, অ্যালার্জি-মুক্ত, বেবি ফ্রেন্ডলি মাইল্ড সাবান ব্যবহার করা উচিত।
প্রশ্ন ৬: প্রতিদিন কি নবজাতকের গোসল প্রয়োজন?
উত্তর: না। গরমে প্রতিদিন এবং শীতে দিন ফেলে গোসল করালেই যথেষ্ট। তবে পরিচ্ছন্নতার জন্য স্পঞ্জ বাথ রাখা যেতে পারে।