নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয়-
জন্মের পর নবজাতক শিশু অত্যন্ত সংবেদনশীল থাকে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পূর্ণভাবে তৈরি হয়নি, তাই সামান্য পরিবর্তনেই জ্বর আসতে পারে। জ্বরকে অনেকেই সাধারণ বিষয় মনে করলেও, নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয় জানা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এ সময় জ্বর অনেক গুরুতর রোগের সংকেত হতে পারে।
নবজাতকের জ্বর কীভাবে চিনবেন-
- সাধারণত নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা ৯৭.৭°F (৩৬.৫°C) থেকে ৯৯.৫°F (৩৭.৫°C) স্বাভাবিক ধরা হয়।
- রেক্টাল (মলদ্বার দিয়ে) তাপমাত্রা ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি হলে জ্বর ধরা হয়।
তাই সবসময় ডিজিটাল থার্মোমিটার ব্যবহার করে শিশুর তাপমাত্রা মাপা উচিত।
নবজাতকের জ্বর হওয়ার সাধারণ কারণ-
১. সংক্রমণ (Infection):
ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাক সংক্রমণ জ্বরের প্রধান কারণ।
২. ভ্যাকসিন নেওয়ার পর:
অনেক সময় টিকা নেওয়ার পর সামান্য জ্বর হতে পারে।
৩. অতিরিক্ত কাপড় পরানো বা গরম পরিবেশ:
নবজাতক শিশুকে বেশি কাপড় পরানো বা বেশি গরমে রাখা হলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
৪. জন্মজনিত জটিলতা:
প্রিম্যাচিউর বাচ্চা বা কোনো জন্মগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের শরীর বেশি সংবেদনশীল থাকে।
৫. সর্দি-কাশি:
সাধারণ ঠান্ডা লাগলেও শিশুর জ্বর হতে পারে।
নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয়-
১. তাপমাত্রা সঠিকভাবে মাপুন:
ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে শিশুর তাপমাত্রা মাপুন।
২. অতিরিক্ত কাপড় খুলে দিন:
শিশুকে হালকা পোশাক পরান এবং স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখুন।
৩. মায়ের দুধ খাওয়ান:
জ্বরের সময় নবজাতক শিশুর শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ান।
৪. গরম পানির সেঁক:
গরম পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে শিশুর শরীর মুছে দিতে পারেন, এতে তাপমাত্রা কমতে সাহায্য করে।
৫. ওষুধ:
নবজাতককে কোনো ওষুধ নিজে থেকে দেবেন না। সবসময় শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
৬. ডাক্তার দেখান:
শিশুর জ্বর যদি ১০০.৪°F (৩৮°C)-এর বেশি হয়, সঙ্গে খাওয়ার আগ্রহ কমে যায়, শ্বাসকষ্ট হয় বা শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ করে, তবে অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে।
কখন জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার দেখাবেন-
- শিশুর বয়স যদি ৩ মাসের কম হয় এবং জ্বর আসে।
- শিশুর খাওয়ার আগ্রহ কমে গেলে।
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস নিতে থাকলে।
- শিশুর শরীর ঢিলে হয়ে গেলে।
- অতিরিক্ত কান্না বা অস্বাভাবিক ঘুম।
- খিঁচুনি হলে।
নবজাতকের জ্বরের চিকিৎসা-
- ডাক্তার সাধারণত শিশুর ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ও প্রয়োজনে রক্ত, প্রস্রাব বা অন্যান্য টেস্ট করতে পারেন।
- সংক্রমণ থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হয়।
- সাপোর্টিভ কেয়ার হিসেবে স্যালাইন, বুকের দুধ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
কখনোই নিজের ইচ্ছায় শিশুকে ওষুধ দেবেন না।
নবজাতকের জ্বর প্রতিরোধে করণীয়-
- শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখুন।
- যারা শিশুকে স্পর্শ করবেন, তাদের হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
- শিশুকে অতিরিক্ত কাপড় পরাবেন না।
- সঠিক সময়ে ভ্যাকসিন দিন।
- শিশুকে ভিড় বা অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখুন।
নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয়: মায়ের ভূমিকা-
নবজাতক শিশুর যত্নে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শরীরে সামান্য পরিবর্তন হলেও মা–ই প্রথম তা বুঝতে পারেন। তাই নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয় বিষয়টিতে মায়ের দায়িত্ব ও করণীয় আলাদা করে দেখা দরকার।
১. শিশুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা:
মা–কে শিশুর খাওয়ার আগ্রহ, ঘুম, কান্না, প্রস্রাব-মলত্যাগের ধরণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। হঠাৎ কোনো অস্বাভাবিকতা হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. বুকের দুধ খাওয়ানো:
জ্বরের সময় শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বুকের দুধ শিশুকে শুধু পুষ্টিই দেয় না, বরং শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।
৩. পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:
মায়ের হাত পরিষ্কার রাখা, শিশুর পোশাক ও বিছানা নিয়মিত পরিবর্তন করা জরুরি।
৪. শিশুকে আরাম দেওয়া:
অতিরিক্ত কাপড় না পরিয়ে হালকা পোশাক পরানো এবং ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা উচিত।
৫. মানসিক শক্তি বজায় রাখা:
শিশুর অসুস্থতার সময় মা–কে শান্ত থাকতে হবে, কারণ মায়ের মানসিক অস্থিরতা শিশুর ওপরও প্রভাব ফেলে।
৬. দ্রুত ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া:
জ্বর বেশি হলে বা শিশুর অন্যান্য গুরুতর উপসর্গ দেখা দিলে মা–কে দেরি না করে অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে।
উপসংহার-
নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয় বিষয়টি জানাটা প্রতিটি অভিভাবকের জন্য অত্যন্ত জরুরি। নবজাতকের জ্বরকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি অনেক সময় গুরুতর রোগের সংকেত হতে পারে। তাই সঠিক সময়ে তাপমাত্রা মাপা, প্রয়োজনীয় যত্ন নেওয়া এবং প্রয়োজনে দ্রুত ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়াই শিশুর সুস্থতার চাবিকাঠি।
নবজাতক শিশুর জ্বর হলে করণীয় সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: নবজাতকের জ্বর কত ডিগ্রি হলে চিন্তার বিষয়?
উত্তর: ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি হলে অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে।
প্রশ্ন ২: জ্বর হলে শিশুকে কি ঘন ঘন খাওয়ানো উচিত?
উত্তর: হ্যাঁ, জ্বরের সময় শিশুকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
প্রশ্ন ৩: নবজাতককে প্যারাসিটামল দেওয়া যাবে কি?
উত্তর: কোনো ওষুধ ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া দেওয়া যাবে না।
প্রশ্ন ৪: অতিরিক্ত কাপড় কি জ্বর বাড়ায়?
উত্তর: হ্যাঁ, অতিরিক্ত কাপড় বা কম্বল ব্যবহার করলে শরীর গরম হয়ে জ্বর আসতে পারে।
প্রশ্ন ৫: টিকা নেওয়ার পর জ্বর হলে কী করবেন?
উত্তর: সাধারণত সামান্য জ্বর টিকার পর স্বাভাবিক। তবে তাপমাত্রা বেশি হলে ডাক্তার দেখান।