প্রসব পরবর্তী বিপদ

প্রসব পরবর্তী বিপদ: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়

প্রসব পরবর্তী বিপদ: মায়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা-

প্রসব একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও সন্তান জন্মের পর মায়ের শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এই সময়কে বলা হয় প্রসব পরবর্তী সময় বা পিউরপেরিয়াম (Puerperium), যা সাধারণত প্রসবের পর প্রথম ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময় মায়ের শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে এ সময় অনেক মা গুরুতর শারীরিক জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন। এই জটিলতাগুলোকে বলা হয় প্রসব পরবর্তী বিপদ। সঠিক জ্ঞান ও যত্নের অভাবে অনেক মা জীবন-সংকটেও পড়তে পারেন।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব প্রসব পরবর্তী বিপদ কী, এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়।

প্রসব পরবর্তী বিপদ কী?-

প্রসব পরবর্তী বিপদ বলতে সন্তান জন্মের পর মায়ের শরীরে ঘটে যাওয়া এমন সব স্বাস্থ্য সমস্যা বা জটিলতাকে বোঝায়, যা মায়ের জীবন ও সুস্থতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। সাধারণত প্রসবের পর প্রথম ২৪ ঘণ্টা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই বিপদ ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

প্রসব পরবর্তী বিপদের কারণ-

প্রসব পরবর্তী বিপদ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Postpartum Hemorrhage)

    • প্রসবের সময় বা পরপরই বেশি রক্তক্ষরণ।
    • এটি মায়ের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।

সংক্রমণ (Puerperal Sepsis)

    • প্রসবের পর জরায়ু বা প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ হলে মায়ের শরীরে জ্বর, ব্যথা ও দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব দেখা দেয়।

রক্তচাপের জটিলতা

    • প্রসবের পর অনেক মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যায়।
    • একে Postpartum Preeclampsia বলা হয়।

রক্ত জমাট বাঁধা (Thrombosis)

    • পায়ে বা ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধলে শ্বাসকষ্ট বা বুকব্যথা হতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

    • প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা (Postpartum Depression) অনেক মায়ের মধ্যে দেখা দেয়।
    • এ সময় মায়ের মানসিক সাপোর্ট খুব জরুরি।

প্রসব পরবর্তী বিপদের লক্ষণ-

মায়ের শরীরে কিছু সতর্ক সংকেত দেখা দিলে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
  • প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা ঝাপসা দেখা।
  • বুকব্যথা বা শ্বাসকষ্ট।
  • তীব্র পেটব্যথা বা জরায়ু শক্ত হওয়া।
  • প্রস্রাবে জ্বালা বা সমস্যা।
  • জ্বর, কাঁপুনি বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব।
  • হঠাৎ হাত-পা ফুলে যাওয়া।
  • অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
  • মানসিক অস্থিরতা, কান্না বা আত্মহত্যার চিন্তা।

প্রসব পরবর্তী বিপদের ঝুঁকি বেশি যাদের মধ্যে-

কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মায়েদের প্রসব পরবর্তী বিপদের ঝুঁকি বেশি থাকে, যেমন:

  • অল্প বয়সে গর্ভধারণ।
  • অতিরিক্ত সন্তান জন্ম।
  • রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) থাকা।
  • সিজারিয়ান অপারেশন হওয়া।
  • প্রসবকালীন জটিলতা থাকা।
  • ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকা।

প্রসব পরবর্তী বিপদের চিকিৎসা-

প্রসব পরবর্তী বিপদ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে জটিলতার ধরন অনুযায়ী।

  • রক্তক্ষরণ হলে: দ্রুত স্যালাইন, রক্ত দেওয়া ও জরায়ু সংকোচনকারী ওষুধ প্রয়োগ।
  • সংক্রমণ হলে: অ্যান্টিবায়োটিক ও জরায়ুর যত্ন।
  • রক্তচাপ বাড়লে: প্রেসার কন্ট্রোলের ওষুধ।
  • রক্ত জমাট বাঁধলে: ব্লাড থিনার ও অক্সিজেন সাপোর্ট।
  • মানসিক সমস্যায়: কাউন্সেলিং, পরিবার ও চিকিৎসকের মানসিক সাপোর্ট।

প্রসব পরবর্তী বিপদ প্রতিরোধের উপায়

সঠিক যত্ন ও সচেতনতার মাধ্যমে প্রসব পরবর্তী বিপদ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

  • গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ করা।
  • প্রসবের সময় প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা চিকিৎসকের কাছে থাকা।
  • প্রসবের পর মায়ের শরীরের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা।
  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া।
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার ও পানি পান করা।
  • সংক্রমণ এড়াতে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
  • পরিবারের সদস্যদের সহায়তা ও মানসিক সমর্থন প্রদান।

মায়েদের জন্য প্রসব পরবর্তী যত্ন-

প্রসবের পর মায়ের শরীর দুর্বল থাকে। তাই সুস্থ থাকার জন্য কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি:

  • প্রচুর বিশ্রাম নেওয়া।
  • পুষ্টিকর খাবার খাওয়া (ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, শাকসবজি, ফল)।
  • পর্যাপ্ত পানি পান করা।
  • স্তন্যদান চালিয়ে যাওয়া।
  • হালকা ব্যায়াম বা হাঁটা।
  • নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া।

উপসংহার-

প্রসব পরবর্তী বিপদ নিয়ে সচেতনতা মায়েদের জীবন বাঁচাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় সামান্য অবহেলায় গুরুতর বিপদ হতে পারে। তাই সন্তান জন্মের পর মায়েদের শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিলে তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

একজন মা সুস্থ থাকলেই নতুন শিশুটি সঠিক যত্ন ও ভালোবাসা পাবে। তাই প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রসব পরবর্তী বিপদ সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১: প্রসব পরবর্তী বিপদ কতদিন পর্যন্ত থাকতে পারে?
উত্তর: সাধারণত প্রসবের পর প্রথম ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বিপদ থাকার সম্ভাবনা বেশি। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হলো প্রথম ২৪ ঘণ্টা।

প্রশ্ন ২: প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ কতটা বিপজ্জনক?
উত্তর: যদি এক ঘণ্টায় এক প্যাড সম্পূর্ণ ভিজে যায়, তবে সেটি বিপজ্জনক রক্তক্ষরণ। দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।

প্রশ্ন ৩: প্রসব পরবর্তী সংক্রমণের লক্ষণ কী কী?
উত্তর: জ্বর, পেটব্যথা, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, দুর্বলতা, মাথাব্যথা ইত্যাদি সংক্রমণের লক্ষণ।

প্রশ্ন ৪: মানসিকভাবে দুর্বলতা কি প্রসব পরবর্তী বিপদের অংশ?
উত্তর: হ্যাঁ, অনেক মা প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতায় ভোগেন, যা চিকিৎসা না নিলে মারাত্মক হতে পারে।

প্রশ্ন ৫: প্রসব পরবর্তী বিপদ কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর: নিয়মিত চেকআপ, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে প্রসব পরবর্তী বিপদ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top