প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ কী?-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ হলো এমন এক অবস্থা যখন শিশুর জন্ম গর্ভাবস্থার ৩৭তম সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই ঘটে। সাধারণত একটি পূর্ণ-সময়ের গর্ভাবস্থা হয় প্রায় ৪০ সপ্তাহের। কিন্তু কোনো কারণে জরায়ুতে সংকোচন শুরু হয়ে গেলে এবং সার্ভিক্স প্রসারিত হয়ে শিশুর জন্ম দ্রুত হয়ে গেলে সেটিকে প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ বলা হয়।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রি-টার্ম বার্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ১.৫ কোটি শিশু প্রি-টার্ম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। এর মধ্যে বহু শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক বা মানসিক সমস্যার সম্ভাবনা থেকে যায়।
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থের ধরন-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ সাধারণত চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়—
- এক্সট্রিমলি প্রি-টার্ম (২৪ সপ্তাহের কম) – শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
- ভেরি প্রি-টার্ম (২৪-৩২ সপ্তাহের মধ্যে) – শিশুর ঝুঁকি বেশি, তবে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক সময় বাঁচানো সম্ভব।
- মডারেট প্রি-টার্ম (৩২-৩৪ সপ্তাহের মধ্যে) – শিশুর ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গ অসম্পূর্ণ থাকে।
- লেট প্রি-টার্ম (৩৪-৩৭ সপ্তাহের মধ্যে) – এ ধরনের শিশু তুলনামূলকভাবে বেশি বেঁচে থাকে, তবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকেই যায়।
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থের কারণ-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ অনেকগুলো কারণে হতে পারে। প্রধান কারণগুলো হলো—
- মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, থাইরয়েড সমস্যা।
- সংক্রমণ যেমন মূত্রনালী সংক্রমণ, ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন।
- একাধিক গর্ভধারণ (টুইন বা ট্রিপলেট)।
- জরায়ুর গঠনগত ত্রুটি বা সার্ভিক্সের দুর্বলতা।
- পূর্ববর্তী প্রি-টার্ম লেবারের ইতিহাস।
- মাতৃজীবনযাত্রা যেমন ধূমপান, মাদক গ্রহণ, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অপর্যাপ্ত পুষ্টি।
- অল্প বয়সে বা বেশি বয়সে গর্ভধারণ।
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা দুর্ঘটনা।
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থের ঝুঁকি-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থের ফলে মা ও শিশুর জন্য নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়।
শিশুর জন্য ঝুঁকি:
- শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের অপর্যাপ্ত বিকাশ
- ব্রেন হেমারেজ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ
- সংক্রমণজনিত জটিলতা
- দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ সমস্যা
- দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা
মায়ের জন্য ঝুঁকি:
- প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ
- সংক্রমণের ঝুঁকি
- মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
প্রি-টার্ম লেবারের লক্ষণ-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ প্রতিরোধের জন্য প্রাথমিক লক্ষণগুলো জানা জরুরি। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো—
- নিয়মিত জরায়ুর সংকোচন বা ব্যথা (২০ মিনিটে ৪ বার বা তার বেশি)
- কোমর ও তলপেটে ক্রমাগত চাপ অনুভব
- যোনি থেকে রক্তপাত বা তরল নির্গমন
- যোনি থেকে পানি বের হওয়া (অ্যামনিওটিক ফ্লুইড লিকেজ)
- সার্ভিক্স ধীরে ধীরে নরম বা প্রসারিত হয়ে যাওয়া
প্রি-টার্ম লেবার নির্ণয়-
ডাক্তাররা কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ নিশ্চিত করতে পারেন। যেমন—
- আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান – শিশুর অবস্থা ও জরায়ুর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ।
- সার্ভিক্যাল পরীক্ষা – সার্ভিক্স প্রসারিত হচ্ছে কিনা তা নির্ণয়।
- ফিটাল ফাইব্রোনেকটিন টেস্ট – লেবারের ঝুঁকি নির্ধারণে সহায়তা করে।
প্রি-টার্ম লেবারের চিকিৎসা-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ প্রতিরোধ বা ঝুঁকি কমাতে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়—
- টোসোলাইটিক ওষুধ – জরায়ুর সংকোচন কমাতে সাহায্য করে।
- কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন – শিশুর ফুসফুস দ্রুত পরিপক্ব হতে সাহায্য করে।
- অ্যান্টিবায়োটিক – সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয়।
- বেড রেস্ট ও পর্যবেক্ষণ – মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে হাসপাতালে পর্যবেক্ষণ জরুরি।
- NICU কেয়ার – প্রিম্যাচিউর শিশুর জন্য নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ প্রতিরোধ-
যদিও সব ক্ষেত্রে প্রি-টার্ম লেবার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ঝুঁকি কমানো যায়—
- গর্ভাবস্থার নিয়মিত চেকআপ করানো।
- সুষম খাবার খাওয়া ও পর্যাপ্ত পানি পান।
- ধূমপান, মাদক বা অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
- সংক্রমণ হলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা।
- পূর্বে প্রি-টার্ম লেবারের ইতিহাস থাকলে শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকা।
প্রি-টার্ম লেবার ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট-
বাংলাদেশে প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতার অভাব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে প্রি-টার্ম শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তবে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে NICU সুবিধা বাড়ছে, যা প্রিম্যাচিউর শিশুদের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রি-টার্ম শিশুর যত্ন-
প্রি-টার্ম শিশুদের জন্য বিশেষ যত্ন প্রয়োজন হয়। যেমন—
- কাংগারু কেয়ার (মায়ের বুকের কাছে শিশুকে রাখা)
- মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো
- শিশুকে উষ্ণ রাখা
- নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও ভিটামিন দেওয়া
উপসংহার-
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ একটি জটিল এবং গুরুতর অবস্থা হলেও সময়মতো সচেতনতা, সঠিক চিকিৎসা ও যত্নের মাধ্যমে অনেক ঝুঁকি কমানো যায়। প্রত্যেক হবু মায়ের উচিত প্রি-টার্ম লেবারের লক্ষণ সম্পর্কে জানা এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
প্রি-টার্ম লেবার ও বার্থ সম্পর্কিত প্রশ্ন-
প্রশ্ন. প্রি-টার্ম লেবার কাকে বলে?
গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে যদি প্রসব শুরু হয়, সেটি প্রি-টার্ম লেবার।
প্রশ্ন. প্রি-টার্ম লেবারের ঝুঁকি কাদের বেশি থাকে?
যেসব মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পূর্বে প্রি-টার্ম লেবারের ইতিহাস, একাধিক গর্ভধারণ বা সংক্রমণ আছে তাদের ঝুঁকি বেশি।
প্রশ্ন. প্রি-টার্ম শিশুরা কি বেঁচে থাকতে পারে?
হ্যাঁ, তবে শিশুর জন্মের সময়কাল যত আগে হবে, ঝুঁকি তত বেশি। উন্নত চিকিৎসা (NICU কেয়ার) পেলে অনেক শিশুই সুস্থভাবে বড় হতে পারে।
প্রশ্ন. প্রি-টার্ম লেবার প্রতিরোধ করা যায় কি?
পুরোপুরি প্রতিরোধ করা না গেলেও, নিয়মিত চেকআপ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, এবং ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চললে ঝুঁকি অনেক কমানো সম্ভব।
প্রশ্ন.প্রি-টার্ম শিশুকে কীভাবে যত্ন নিতে হয়?
প্রি-টার্ম শিশুর জন্য কাংগারু কেয়ার, বুকের দুধ, উষ্ণ পরিবেশ এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি।