বুকের দুধ থেকে বাচ্চার কম ক্যালরি : কারণ, লক্ষণ, সমাধান ও প্রতিরোধ

 

বুকের দুধ থেকে বাচ্চার কম ক্যালরি : একটি পরিচিতি-

মায়ের বুকের দুধকে শিশুর জন্য প্রাকৃতিক সেরা খাদ্য বলা হয়। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের দুধই শিশুর সুস্থতা ও সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে তার ওজন বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, সে বেশি কান্নাকাটি করে বা বারবার ক্ষুধার্ত থাকে।

বুকের দুধে পর্যাপ্ত ক্যালরি না পেলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভাব পড়ে। তাই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রতিটি মা–বাবার জন্য জরুরি।

বুকের দুধে ক্যালরির পরিমাণ-

  • সাধারণত মায়ের দুধে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৬৫–৭০ ক্যালরি থাকে।
  • জন্মের পর প্রথম কয়েকদিনে যে ঘন হলুদ রঙের দুধ (Colostrum) আসে, তাতে প্রচুর প্রোটিন ও অ্যান্টিবডি থাকে, তবে ক্যালরির পরিমাণ তুলনামূলক কম।
  • কয়েকদিন পর আসে ফোরমিল্ক (Foremilk) – এটি পাতলা হয় এবং তাতে পানি বেশি থাকে।
  • খাওয়ানোর শেষ দিকে আসে হাইন্ডমিল্ক (Hindmilk) – এটি ঘন ও ফ্যাট সমৃদ্ধ, যেখানে ক্যালরি বেশি থাকে।

শিশু যদি প্রতিবার খাওয়ানোর সময় শুধু ফোরমিল্ক বেশি খেয়ে হাইন্ডমিল্ক না পায়, তবে তার ক্যালরির ঘাটতি হতে পারে।

বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে এর কারণ-

১. দুধের গুণগত মানে ভিন্নতা:
প্রথম দুধ (ফোরমিল্ক) তুলনামূলক কম ক্যালরি যুক্ত। যদি শিশু কেবল সামনের দুধ খেয়ে পেট ভরে ফেলে, তবে ক্যালরির ঘাটতি হবে।

২. খাওয়ানোর সময় কম হওয়া:
অনেক সময় মা বাচ্চাকে বারবার খাওয়ান, কিন্তু প্রতিবার খুব অল্প সময়ের জন্য। এতে বাচ্চা শেষের ঘন দুধ (হাইন্ডমিল্ক) পায় না।

৩. মায়ের খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্য:
যদি মায়ের পুষ্টি ঘাটতি থাকে বা পর্যাপ্ত ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার না খান, তবে দুধের মানে প্রভাব পড়ে।

৪. দুধ কম হওয়া:
কিছু মায়ের দুধ উৎপাদন স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়, এতে শিশুর চাহিদা মেটে না।

৫. শিশুর খাওয়ার অসুবিধা:
শিশুর মুখের গঠন (যেমন জিহ্বার নিচে ত্বক আটকানো বা tongue-tie) বা চুষতে সমস্যা থাকলে সঠিকভাবে দুধ খেতে পারে না।

৬. অসুস্থতা:
শিশু অসুস্থ হলে বা সংক্রমণ থাকলে সঠিকভাবে খেতে না চাওয়ায় ক্যালরি ঘাটতি হতে পারে।

বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে লক্ষণ-

  • বাচ্চার ওজন না বাড়া বা ধীরে বাড়া
  • অতিরিক্ত কান্নাকাটি ও বিরক্ত হওয়া
  • ঘন ঘন ক্ষুধার্ত হওয়া
  • দিনে ৫–৬ বারের কম প্রস্রাব হওয়া
  • ত্বক ঢিলে বা শুষ্ক হওয়া
  • বাচ্চার শক্তি কম থাকা, অলস হয়ে যাওয়া
  • অতিরিক্ত ঘুমানো বা খুব দুর্বল হওয়া

নবজাতকের ক্যালরি চাহিদা-

  • প্রথম মাসে: দৈনিক প্রতি কেজি ওজনে প্রায় ১১০ ক্যালরি প্রয়োজন।
  • ৩–৬ মাসে: প্রতিদিন প্রতি কেজি ওজনে ৯০–১০০ ক্যালরি দরকার হয়।
  • বুকের দুধ যদি যথেষ্ট ক্যালরি দিতে না পারে, তবে শিশুর ওজন বৃদ্ধি ব্যাহত হবে।

বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে সমাধান-

১. একবারে একটি স্তন সম্পূর্ণ খাওয়ান:
শিশুকে একবারে এক স্তনের দুধ শেষ করতে দিন, যাতে হাইন্ডমিল্ক পায়।

২. নিয়মিত খাওয়ানো:
প্রথম ৬ মাসে শিশুকে দিনে অন্তত ৮–১২ বার খাওয়ানো উচিত।

৩. সঠিকভাবে চুষতে পারছে কিনা খেয়াল করুন:
শিশু সঠিকভাবে ল্যাচ করছে কিনা (মায়ের স্তনবৃন্ত ও আশপাশের অংশ মুখে নিচ্ছে কিনা) তা দেখা জরুরি।

৪. মায়ের খাদ্যাভ্যাস উন্নত করা:
মা পর্যাপ্ত ক্যালরি, প্রোটিন, পানি ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করলে দুধের মান ভালো হয়।

৫. ওজন নিয়মিত মাপা:
প্রতি মাসে শিশুর ওজন মাপুন। প্রথম ৬ মাসে মাসে অন্তত ৬০০–৯০০ গ্রাম ওজন বাড়া স্বাভাবিক।

৬. চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া:
যদি মনে হয় দুধ কম হচ্ছে বা শিশু যথেষ্ট ক্যালরি পাচ্ছে না, তবে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে ফর্মুলা মিল্ক ব্যবহার করা হতে পারে (শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শে)।

বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব-

  • ওজন কমে যাওয়া ও অপুষ্টি
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
  • মানসিক বিকাশে বিলম্ব
  • ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া
  • শারীরিক দুর্বলতা

বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে প্রতিরোধ-

  • জন্মের পরপরই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করুন।
  • মায়ের খাবারে ভিটামিন, মিনারেল ও প্রোটিন রাখুন।
  • নিয়মিত পানি পান করুন।
  • শিশুকে চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ান।
  • খাওয়ানোর সময় মনোযোগ দিয়ে শিশুকে পর্যবেক্ষণ করুন।
  • দুধ কম হলে বা কোনো সমস্যা হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

কখন ডাক্তার দেখাবেন?-

  • শিশুর ওজন না বাড়লে
  • দিনে প্রস্রাব ৫ বারের কম হলে
  • শিশু দুর্বল বা অতিরিক্ত ঘুমায়
  • শিশু খেতে না চাইলে
  • বুকের দুধ যথেষ্ট মনে না হলে

উপসংহার-

বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে শিশুর শারীরিক, মানসিক ও প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই শিশুর খাওয়ার ধরণ, ওজন বৃদ্ধি এবং প্রস্রাবের পরিমাণ নিয়মিত লক্ষ্য করা জরুরি। সচেতনতা, সঠিক খাওয়ানোর কৌশল ও সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যা প্রতিরোধ ও সমাধান সম্ভব।

 বুকের দুধ থেকে বাচ্চা কম ক্যালরি পেলে (প্রশ্নউত্তর)-

প্রশ্ন ১: বুকের দুধ কি সবসময় যথেষ্ট ক্যালরি দেয়?
উত্তর: সাধারণত হ্যাঁ। তবে যদি শিশু হাইন্ডমিল্ক না পায় বা মা–এর দুধ কম হয়, তবে ক্যালরির ঘাটতি হতে পারে।

প্রশ্ন ২: শিশুর ওজন না বাড়লে কি শুধু দুধের সমস্যা?
উত্তর: সবসময় না। শিশুর অন্য অসুস্থতা বা সংক্রমণও কারণ হতে পারে।

প্রশ্ন ৩: বুকের দুধ কম হলে কী করবেন?
উত্তর: শিশুকে ঘন ঘন খাওয়ান, মায়ের পুষ্টি বাড়ান এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন ৪: ফর্মুলা মিল্ক দেওয়া কি জরুরি?
উত্তর: শুধু তখনই যখন ডাক্তার মনে করেন বুকের দুধ যথেষ্ট হচ্ছে না।

প্রশ্ন ৫: বুকের দুধের ক্যালরি কীভাবে বাড়ানো যায়?
উত্তর: মায়ের খাদ্যাভ্যাস উন্নত করলে এবং শিশুকে এক স্তনের দুধ শেষ করতে দিলে ক্যালরি যথেষ্ট পাওয়া যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top