মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগলে কী করবেন? করণীয়, পরামর্শ ও মানসিক স্বাস্থ্য টিপস

মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে কী করবেন? গাইডলাইন –

সন্তান জন্মের পর একজন মা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন সময়ের মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই আনন্দের মুহূর্তটি হয়ে ওঠে মানসিক চ্যালেঞ্জের কারণ, বিশেষ করে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা সন্তান জন্মের পর বিষণ্ণতার মতো সমস্যা দেখা দিলে। মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে কী করবেন? —এটি এমন একটি প্রশ্ন যা বহু মা, পরিবার ও স্নেহধন্যজনের মনে জাগে। এই ব্লগে আমরা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ, কারণ, প্রভাব এবং করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসবোত্তর কী?-

পোস্টপার্টাম (Postpartum) শব্দের অর্থ হলো “সন্তান প্রসবের পরবর্তী সময়কাল”। বাংলায় একে বলা হয় “প্রসবোত্তর সময়”। এই সময়টি সাধারণত শিশুর জন্মের প্রথম ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ধরা হয়, তবে অনেক সময় এটি ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্তও প্রসারিত হতে পারে। এটি একজন নারীর জীবনের এক বিশেষ পর্যায়, যেখানে শারীরিক, মানসিক ও আবেগিক নানা পরিবর্তন ঘটে।

প্রসবোত্তর সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

শারীরিক পরিবর্তন-

  • জরায়ু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে

  • স্তনে দুধ উৎপাদন শুরু হয়

  • রক্তপাত ও লুচিয়া (Lochia) হয়

  • ঘুমের ঘাটতি ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে

হরমোন পরিবর্তন-

সন্তান জন্মের পর ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা হঠাৎ করে কমে যায়, যা মানসিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই কারণে অনেক মা বিষণ্ণতা বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগতে পারেন।

মানসিক ও আবেগিক পরিবর্তন-

  • উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা বা অকারণে কান্না পাওয়া

  • শিশু লালনপালন নিয়ে ভয়

  • কখনো কখনো “baby blues” যা হালকা বিষণ্ণতা

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন লক্ষণসমূহ-

নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগছেন বলে বোঝা যেতে পারে—

  • অতিরিক্ত মন খারাপ ও কান্না পাওয়া
  • একা অনুভব করা বা নিজেকে মূল্যহীন মনে হওয়া
  • ঘুমের সমস্যা বা অতিরিক্ত ঘুম
  • অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা বা অধৈর্য্য
  • শিশু সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা করা
  • স্বামী বা পরিবারের প্রতি বিরক্তি
  • নিজেকে বা শিশুকে ক্ষতি করার ভাবনা (চরম ক্ষেত্রে)
  • আগ্রহের অভাব – এমনকি প্রিয় কাজে মন না বসা

মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে কী করবেন?-

১. নিজেকে দোষারোপ করবেন না-

প্রথমত মনে রাখবেন, পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কোনো দুর্বলতা নয়। এটি হরমোনাল, মানসিক এবং পরিবেশগত প্রভাবের কারণে হয়ে থাকে। আপনি একা নন।

২. বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নিন-

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোস্বাস্থ্য পরামর্শদাতার সঙ্গে কথা বলুন। অনেক সময় চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে।

৩. পরিবারের সহায়তা গ্রহণ করুন-

সংসার, সন্তান এবং নিজের দায়িত্ব একা কাঁধে তুলে না নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিন। বাবা, মা, স্বামী বা বন্ধুরা মানসিকভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

৪. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম নিশ্চিত করুন-

ঘুমের অভাব পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনএর অন্যতম কারণ। যখনই সম্ভব বিশ্রাম নিন। শিশুর ঘুমের সঙ্গে নিজের ঘুম মেলাতে চেষ্টা করুন।

৫. পুষ্টিকর খাবার খান

সুস্থ শরীর মানেই সুস্থ মন। তাই প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

৬. হালকা ব্যায়াম করুন

প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি বা হালকা ব্যায়াম করুন। এতে শরীরে এন্ডরফিন নামে সুখ হরমোন নিঃসরণ হয়, যা মন ভালো করতে সাহায্য করে।

৭. নিজের জন্য সময় রাখুন

মা হওয়া মানে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া নয়। দিনে অন্তত কিছু সময় নিজের পছন্দের কাজ, হবি বা ধ্যানের জন্য রাখুন।

৮. খোলামেলা কথা বলুন

আপনার মনের কথা স্বামীর সঙ্গে, মা-বাবার সঙ্গে বা বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করুন। নিজের অনুভূতি গোপন না রেখে প্রকাশ করলেই উপশম হয়।

৯. সহানুভূতিশীল কমিউনিটির অংশ হোন

অনলাইন বা অফলাইন postpartum support group বা মায়েদের কমিউনিটিতে যোগ দিন। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখা যায়।

১০. ধৈর্য্য ধরুন

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে সময় লাগে। ধৈর্য্য সহকারে চিকিৎসা এবং আত্ম-উন্নয়নের পথ অনুসরণ করুন।

 পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের কারণসমূহ-

  • হরমোন পরিবর্তন: সন্তান জন্মের পর ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা হঠাৎ কমে যায়, যা মেজাজে প্রভাব ফেলে।
  • ঘুমের অভাব: নবজাতকের যত্নে ঘুমের ব্যাঘাত হয়, যা মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • চাপ ও দুশ্চিন্তা: নবজাতকের যত্ন, পারিবারিক দায়িত্ব এবং নিজের শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা।
  • পূর্বের মানসিক অবস্থা: আগে হতাশা বা উদ্বেগে ভুগে থাকলে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন চিকিৎসাবিহীন থাকলে কী হয়?-

যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে:

  • মা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন
  • শিশুর সঠিক যত্ন ব্যাহত হয়
  • সম্পর্কের উপর প্রভাব পড়ে
  • চরম বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যার ঝুঁকি তৈরি হয়

তাই দেরি না করে উপযুক্ত চিকিৎসা ও সহানুভূতিশীল ব্যবস্থার মাধ্যমে মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে কী করবেন?—এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে নেওয়াই জরুরি।

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয়-

  • প্রতিদিন ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন করুন
  • দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করুন এবং তা অনুসরণ করুন
  • প্রতিদিন অন্তত একজন প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলুন
  • নিজের সাফল্য ও ইতিবাচক দিকগুলো লিখে রাখুন
  • সামাজিক মাধ্যম থেকে কিছুটা বিরতি নিন

 কিছু ঘরোয়া উপায় যা মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে-

  • তুলসী পাতার চা বা গ্রিন টি পান করুন
  • সুগন্ধি ব্যবহার করুন যা মন ভালো রাখে (ল্যাভেন্ডার, লেমনগ্রাস)
  • হালকা সঙ্গীত শুনুন
  • বাচ্চার সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটান

 মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে স্বামীর করণীয়-

  • স্ত্রীর পাশে থাকুন, অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করুন
  • তাকে সময় দিন ও শোনার মনোভাব রাখুন
  • সন্তানের যত্নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন
  • তাকে নিজের মতো করে সময় কাটাতে উৎসাহ দিন

 উপসংহার-

মা হওয়া যেমন আশীর্বাদ, তেমনই একটি বিশাল দায়িত্ব। জন্মের পর মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা একটি বাস্তবতা। কিন্তু মনে রাখবেন—মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে কী করবেন?, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব, আর আপনি একা নন।

চিকিৎসা, ভালোবাসা, পরিবার ও নিজের যত্নের মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জ পার হওয়া যায়। নিজেকে সময় দিন, সহানুভূতি দেখান এবং ভালো থাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান।

প্রশ্নউত্তর-

১. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কতদিন স্থায়ী হয়?
এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। সাধারণত কয়েক সপ্তাহ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হতাশা দেখা দেয়, যেটি চিকিৎসা ছাড়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।

২. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কি স্বাভাবিক?
হ্যাঁ, এটি খুবই সাধারণ। প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ১ জন এই সমস্যায় ভোগেন। তবে এটি স্বাভাবিক হলেও অবহেলা করা উচিত নয়।

৩. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়?
পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার, চিকিৎসকের পরামর্শ, পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া যায়।

৪. মা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন এ ভুগলে কী করা উচিত?
সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের সহায়তা নিতে হবে এবং নিজেকে সময় দিতে হবে।

৫. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কি শুধু প্রথম সন্তানের পর হয়?
না, এটি যে কোনো সন্তান জন্মের পর হতে পারে, প্রথম হোক বা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়।

৬. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কি শিশু জন্মের সাথে সাথেই শুরু হয়?
অনেক সময় প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু মাস পরও শুরু হতে পারে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top