মোলার প্রেগনেন্সি কি?- কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

মোলার প্রেগনেন্সি কি?

মোলার প্রেগনেন্সি হলো গর্ভাবস্থার একটি বিরল কিন্তু গুরুতর সমস্যা, যেখানে জরায়ুর ভেতরে সঠিক ভ্রূণ গঠিত না হয়ে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একে “Hydatidiform mole” বলা হয়। সাধারণ গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ ও প্লাসেন্টা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে, কিন্তু মোলার প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে প্লাসেন্টার টিস্যুতে অনেকগুলো ছোট ছোট ফোঁড়া বা সিস্ট তৈরি হয়, যা দেখতে অনেকটা আঙুরের ঝাড়ের মতো লাগে।

এটি মূলত গর্ভাবস্থার এক ধরনের জটিলতা, যা সঠিক সময়ে ধরা না পড়লে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই “মোলার প্রেগনেন্সি কি” এ প্রশ্নের উত্তর শুধু জানাই নয়, এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়েও জানা জরুরি।

মোলার প্রেগনেন্সির ধরণ-

মোলার প্রেগনেন্সি মূলত দুই ধরনের হয়।

পূর্ণ মোলার প্রেগনেন্সি (Complete Mole)

পূর্ণ মোলের ক্ষেত্রে কোনো ভ্রূণ তৈরি হয় না। জরায়ুর ভেতরে শুধুমাত্র অস্বাভাবিক টিস্যুর বৃদ্ধি হতে থাকে। এটি সবচেয়ে বেশি জটিল হতে পারে।

আংশিক মোলার প্রেগনেন্সি (Partial Mole)

আংশিক মোলের ক্ষেত্রে ভ্রূণ তৈরি হলেও সেটি অস্বাভাবিক হয় এবং বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে না। প্লাসেন্টা ও ভ্রূণের কোষে অস্বাভাবিক জিনগত পরিবর্তন দেখা দেয়।

মোলার প্রেগনেন্সি হওয়ার কারণ-

“মোলার প্রেগনেন্সি কি” বোঝার পাশাপাশি এর কারণ জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১. জেনেটিক সমস্যা – সাধারণত শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর অস্বাভাবিক জিনগত মিলন হলে এটি ঘটে।
২. খালি ডিম্বাণু (Empty Egg) – অনেক সময় ডিম্বাণুতে কোনো জিনগত উপাদান থাকে না। এ ক্ষেত্রে শুধু শুক্রাণুর জিন প্রবেশ করে এবং অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শুরু হয়।
৩. অতিরিক্ত ক্রোমোজোম সংখ্যা – স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্রোমোজোম থাকলে অস্বাভাবিক কোষ গঠন হয়।
৪. বয়সজনিত কারণ – ২০ বছরের নিচে বা ৩৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের এ ঝুঁকি বেশি।
৫. পূর্বের ইতিহাস – আগে কারো মোলার প্রেগনেন্সি হয়ে থাকলে পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মোলার প্রেগনেন্সির লক্ষণ-

“মোলার প্রেগনেন্সি কি” জানতে গেলে এর উপসর্গগুলো জানা সবচেয়ে জরুরি। সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার লক্ষণের মতো মনে হতে পারে। তবে কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে:

১. অতিরিক্ত বমি বমি ভাব ও বমি – সাধারণ প্রেগনেন্সির তুলনায় বেশি হয়।
২. অসাধারণ যোনিপথে রক্তপাত – গাঢ় বাদামি বা লালচে রক্ত আসতে পারে।
৩. পেটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি – স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় জরায়ু বড় হয়ে যায়।
৪. আঙুরের মতো ফোঁড়া বের হওয়া – যোনি দিয়ে ছোট ছোট ফোঁড়া বের হতে পারে।
৫. তীব্র পেট ব্যথা ও অস্বস্তি
৬. রক্তচাপ বৃদ্ধি ও প্রি-এক্লাম্পসিয়ার মতো উপসর্গ গর্ভাবস্থার প্রথম দিকেই দেখা দিতে পারে।

মোলার প্রেগনেন্সির জটিলতা-

এই সমস্যা শুধু গর্ভপাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আরও অনেক জটিলতা তৈরি করতে পারে।

  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
  • ডিম্বাণুর টিস্যুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (Gestational Trophoblastic Neoplasia)
  • দুর্লভ ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রূপ নেওয়া (Choriocarcinoma)
  • বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি
  • মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা – হঠাৎ গর্ভপাত বা অস্বাভাবিকতা মানসিকভাবে ভেঙে দিতে পারে।

মোলার প্রেগনেন্সি নির্ণয়-

সঠিকভাবে “মোলার প্রেগনেন্সি কি” বোঝার জন্য ডায়াগনোসিস করা জরুরি। এর জন্য সাধারণত যেসব পরীক্ষা করা হয়:

  • আল্ট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasound) – জরায়ুর ভেতরে আঙুরের মতো গুচ্ছ টিস্যু দেখা যায়।
  • বিটা-hCG টেস্ট – হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি থাকে।
  • রক্ত পরীক্ষা ও অন্যান্য ল্যাব টেস্ট – অস্বাভাবিকতা যাচাইয়ের জন্য করা হয়।

মোলার প্রেগনেন্সির চিকিৎসা-

মোলার প্রেগনেন্সি ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হয়। সাধারণ চিকিৎসাগুলো হলো:

১. ডিএন্ডসি (Dilation and Curettage) – জরায়ুর ভেতরের অস্বাভাবিক টিস্যু অপসারণ করা হয়।
২. ঔষধ প্রয়োগ – কিছু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে যদি টিস্যু আবার বাড়তে থাকে।
৩. নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা – বিটা-hCG মাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
৪. গর্ভধারণ এড়িয়ে চলা – চিকিৎসার পর অন্তত ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত গর্ভধারণ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।

মোলার প্রেগনেন্সি প্রতিরোধ-

এটি সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু সতর্কতা নিলে ঝুঁকি কমানো যায়।

  • বিয়ের বয়সের আগে গর্ভধারণ না করা
  • সুস্থ জীবনযাপন ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া
  • ফোলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন গ্রহণ
  • পূর্বে মোলার প্রেগনেন্সি হয়ে থাকলে গর্ভধারণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো

উপসংহার-

“মোলার প্রেগনেন্সি কি” এই প্রশ্নের উত্তর শুধু জানাই নয়, বরং এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতন থাকাও প্রয়োজন। এটি একটি জটিল কিন্তু নিরাময়যোগ্য সমস্যা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা ও নিয়মিত ফলোআপ মায়ের ভবিষ্যৎ গর্ভধারণের সম্ভাবনা নিশ্চিত করে। তাই গর্ভাবস্থায় কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মোলার প্রেগনেন্সি কি? সম্পর্কিত প্রশ্ন-

প্রশ্ন: মোলার প্রেগনেন্সি কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য?
মোলার প্রেগনেন্সি সাধারণত সঠিক চিকিৎসায় নিরাময় হয়। তবে চিকিৎসার পর নিয়মিত ফলোআপ করা জরুরি।

প্রশ্ন: মোলার প্রেগনেন্সি হলে কি ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়া সম্ভব?
হ্যাঁ, চিকিৎসা সম্পন্ন হওয়ার পর ও ডাক্তার অনুমতি দিলে ভবিষ্যতে সুস্থ গর্ভধারণ সম্ভব।

প্রশ্ন: মোলার প্রেগনেন্সি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে কি?
হ্যাঁ, খুব কম ক্ষেত্রে এটি ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে। তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে ঝুঁকি কম থাকে।

প্রশ্ন: মোলার প্রেগনেন্সির লক্ষণ কখন প্রকাশ পায়?
সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

প্রশ্ন: মোলার প্রেগনেন্সি হলে কি আবার হওয়ার ঝুঁকি আছে?
হ্যাঁ, একবার হলে পুনরায় হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ভবিষ্যতে গর্ভধারণের আগে পরীক্ষা ও পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top