লেবার পেইনের লক্ষণ

লেবার পেইনের লক্ষণ: প্রসব বেদনা কখন শুরু হয় ও কিভাবে বুঝবেন?

লেবার পেইনের লক্ষণ: ভূমিকা-

প্রসবকাল একজন নারীর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, কখন প্রসব বেদনা শুরু হবে? এ সময় শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে যা মা ও পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। অনেক সময় গর্ভবতী নারী ঠিক বুঝতে পারেন না এটি আসলেই প্রসব বেদনা নাকি স্বাভাবিক শারীরিক অস্বস্তি। তাই লেবার পেইনের লক্ষণ সম্পর্কে জানা প্রতিটি মায়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

লেবার পেইন কি?-

লেবার পেইন হলো প্রসবকালীন ব্যথা যা জরায়ুর সংকোচন (contraction) ও সারভিক্স প্রসারণের (cervical dilation) কারণে হয়ে থাকে। এই ব্যথার মাধ্যমে ভ্রূণ ধীরে ধীরে জরায়ু থেকে বের হয়ে আসে। লেবার পেইন প্রাথমিকভাবে হালকা হলেও ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে ওঠে এবং প্রসবের সময় ভীষণ কষ্টকর হয়।

লেবার পেইনের প্রাথমিক লক্ষণ-

লেবার পেইনের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো:

  • পিঠের নিচের অংশে ব্যথা – প্রথমে হালকা হয়, পরে বাড়তে থাকে।
  • পেটের নিচে চাপ অনুভব – ভ্রূণ নীচের দিকে নেমে আসার কারণে পেট ভারী লাগে।
  • অনিয়মিত সংকোচন – জরায়ুতে হালকা সংকোচন শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে নিয়মিত হয়।
  • সাদা বা গোলাপি রঙের স্রাব – মিউকাস প্লাগ বের হয়ে আসতে পারে।
  • ক্লান্তি ও অস্থিরতা – শরীর ভারী লাগা এবং মন অস্থির হয়ে ওঠা।

আসল লেবার পেইনের লক্ষণ-

অনেক সময় মায়েরা “ফলস লেবার” (ভুয়া প্রসব বেদনা) আর আসল লেবার পেইনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। আসল লেবার পেইনের লক্ষণগুলো হলো:

  • সংকোচন নিয়মিত ও শক্তিশালী হয়
  • প্রতি সংকোচনের ব্যবধান কমতে থাকে (১০ মিনিট → ৫ মিনিট → ২ মিনিট)
  • ব্যথা পিঠ থেকে পেট ও উরুতে ছড়িয়ে পড়ে
  • জল ভাঙা (Water break) – অ্যামনিওটিক স্যাক ফেটে পানি বের হয়।
  • সারভিক্স প্রসারণ – চিকিৎসক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেন।

লেবার পেইনের সময় যে শারীরিক পরিবর্তন হয়-

  • জরায়ুর পেশি বারবার সংকুচিত হয়।
  • সারভিক্স ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় (১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত)।
  • ভ্রূণ ধীরে ধীরে জন্মনালীর দিকে অগ্রসর হয়।
  • মায়ের শরীরে হরমোনের মাত্রা (অক্সিটোসিন) বৃদ্ধি পায়।

লেবার পেইনের ধাপ-

লেবার পেইন মূলত তিনটি ধাপে বিভক্ত:

  • প্রথম ধাপ – সারভিক্স প্রসারিত হতে শুরু করে। ব্যথা অনিয়মিত থাকে।
  • দ্বিতীয় ধাপ – সারভিক্স সম্পূর্ণ খোলা হয় এবং ভ্রূণ নীচে নেমে আসে। এই ধাপে ব্যথা সবচেয়ে বেশি হয়।
  • তৃতীয় ধাপ – শিশুর জন্মের পর প্লাসেন্টা বের হয়। এ সময় ব্যথা ধীরে ধীরে কমে আসে।

ফলস লেবার ও আসল লেবারের পার্থক্য-

বিষয় ফলস লেবার আসল লেবার
সংকোচন অনিয়মিত নিয়মিত ও ক্রমশ তীব্র
ব্যথার অবস্থান শুধু পেটে পিঠ থেকে পেটে ছড়িয়ে পড়ে
সময়কাল কম সময় স্থায়ী হয় দীর্ঘ ও শক্তিশালী হয়
বিশ্রাম নিলে কমে যায় কমে না
সারভিক্স প্রসারণ হয় না ধীরে ধীরে হয়

লেবার পেইনের লক্ষণ দেখলে করণীয়-

  • শান্ত থাকতে হবে, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না।
  • পরিবারের সদস্যকে জানাতে হবে।
  • হাসপাতালের ব্যাগ প্রস্তুত রাখতে হবে।
  • প্রসব কেন্দ্র বা হাসপাতালে দ্রুত যেতে হবে।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।

লেবার পেইনের সময় ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ-

কিছু ক্ষেত্রে লেবার পেইন জটিল হয়ে উঠতে পারে। যেমন:

  • অতিরিক্ত রক্তপাত
  • ভ্রূণের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া
  • পানির রঙ সবুজ বা বাদামি হওয়া
  • মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
  • দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথা চলা কিন্তু শিশুর জন্ম না হওয়া

এমন হলে দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।

লেবার পেইন সহনীয় করার উপায়-

  • গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া
  • হালকা হাঁটাহাঁটি করা
  • সাপোর্টিভ বালিশ ব্যবহার করা
  • পানিশূন্যতা এড়াতে পানি বা স্যুপ খাওয়া
  • মানসিক সাপোর্ট পাওয়া (স্বামী/পরিবারের কাছ থেকে)
  • প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে এপিডুরাল বা অন্যান্য ব্যথানাশক নেওয়া

লেবার পেইনের সময় পরিবার ও স্বামীর ভূমিকা-

প্রসবকালীন সময় নারীর মানসিক শক্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। এ সময় স্বামী ও পরিবারের দায়িত্ব হলো:

  • মাকে মানসিকভাবে শান্ত রাখা।
  • নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখা।
  • সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
  • মা ও শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।

লেবার পেইনের জন্য প্রস্তুতি-

  • গর্ভাবস্থার শেষ দিকে নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপ করা।
  • প্রয়োজনীয় মেডিকেল রিপোর্ট ও কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা।
  • প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ মনে রাখা।
  • প্রয়োজনীয় পোশাক, নবজাতকের কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র প্রস্তুত রাখা।

উপসংহার-

লেবার পেইনের লক্ষণ প্রতিটি গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারের জানা উচিত। কারণ এটি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। লেবার পেইন ভয়ঙ্কর মনে হলেও সঠিক প্রস্তুতি, মানসিক শক্তি এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই প্রসব প্রক্রিয়া অনেক নিরাপদ ও সহজ হয়।

লেবার পেইনের লক্ষণ সম্পর্কিত প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১: লেবার পেইনের প্রথম লক্ষণ কী?
উত্তর: পিঠের নিচে ও পেটের নিচে চাপ অনুভব এবং অনিয়মিত সংকোচনই লেবার পেইনের প্রথম লক্ষণ।

প্রশ্ন ২: আসল লেবার পেইন আর ভুয়া লেবারের মধ্যে পার্থক্য কিভাবে বুঝবো?
উত্তর: আসল লেবারে সংকোচন নিয়মিত হয় এবং ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়ে, বিশ্রামে কমে না। ভুয়া লেবারে সংকোচন অনিয়মিত হয় এবং বিশ্রামে কমে যায়।

প্রশ্ন ৩: লেবার পেইনের সময় কতক্ষণ পর পর সংকোচন হয়?
উত্তর: শুরুতে ১০-১৫ মিনিট পর পর হয়, পরে ৫-২ মিনিট ব্যবধানে হতে থাকে।

প্রশ্ন ৪: লেবার পেইনের সময় বাড়িতে থাকা নিরাপদ কি?
উত্তর: না, প্রথম লক্ষণ দেখা দিলেই হাসপাতালে যাওয়া উচিত।

প্রশ্ন ৫: লেবার পেইন কমানোর উপায় কী?
উত্তর: শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, হালকা হাঁটা, পানি খাওয়া, পরিবারের সাপোর্ট এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের দেওয়া ব্যথানাশক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top