শিশুদের প্রতি দয়া: ইসলাম, নৈতিকতা ও আধুনিক সমাজে গুরুত্ব

শিশুদের প্রতি দয়া: মানবতার ভিত্তি-

শিশু একটি পরিবারের নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য রহমত। তারা নিষ্পাপ, কোমল ও নির্মল মন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাই শিশুদের প্রতি দয়া দেখানো শুধু মানবতার শিক্ষা নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বও বটে।

কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না; তাদের রিজিক আমি দিই এবং তোমাদেরও দিই।” (সুরা আল-ইসরা: ৩১)

এ আয়াত শিশুদের নিরাপত্তা, যত্ন ও দয়ার প্রতি ইসলামের কঠোর নির্দেশনার প্রমাণ।

নবী করীম ﷺ বলেছেন:
“যে ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (মুসনাদ আহমদ)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছেলে ইব্রাহীমের মৃত্যুতে যখন তাঁর দু নয়ন দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল, এ দেখে আব্দুর রহমান বিন আউফ বলে উঠল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও কাঁদছেন?

অত:পর তিনি বললেন:(«يا ابن عوف، إنها رحمة ثم أتبعها بأخرى» وقال: إن العين تدمع والقلب يحزن، ولا نقول إلا ما يرضي ربنا، وإنا لفراقك يا إبراهيم لمحزنون».)

ওহে ইবনে আউফ! এ তো দয়া, অত:পর তিনি আবার অশ্রু ঝরালেন। তারপর তিনি বললেন: নিশ্চয়ই চোখের অশ্রু প্রবাহিত হবে, হৃদয় চিন্তিত হবে, আর আল্লাহ যাতে সন্তুষ্ট আমরা তাই বলব। তারপর বললেন: ওহে ইব্রাহীম! তোমার মৃত্যুতে আমরা সবাই চিন্তিত।

এই হাদীস থেকেই বোঝা যায় শিশুদের প্রতি দয়া কেবল আবেগ নয়, এটি ঈমানের অংশ।

(ইসলামে শিশু পরিচর্যা: কুরআন ও হাদীসের আলোকে সঠিক দিকনির্দেশনা)

ইসলামে শিশুদের প্রতি দয়ার গুরুত্ব-

ইসলামে শিশুদের প্রতি দয়া দেখানো একটি সুন্নাহ। নবী করীম ﷺ শিশুদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত মমতাশীল।

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: (أن النبي – صلى الله عليه وسلم – أخذ ولده إبراهيم فقبله وشمه )

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ছেলে ইব্রাহীমকে কোলে নিয়ে চুমা দিলেন ও [আরবের রীতি অনুসারে] ঘ্রাণ নিলেন।

  • তিনি শিশুদের আদর করতেন, কোলে নিতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
  • শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতেন।
  • শিশুরা ভুল করলে ধৈর্যের সাথে শিক্ষা দিতেন।
  • কন্যা সন্তানকে দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করার ব্যাপারে অনেক সওয়াবের কথা বলেছেন।আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: («كان رسول الله – صلى الله عليه وسلم – يلاعب زينب بنت أم سلمة، وهو يقول: يا زوينب، يا زوينب، مرارًا»)

 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে সালামার ছোট কন্যা যায়নাবকে নিয়ে খেলা করতেন আর বার বার বলতেন: হে      যুয়াইনাব, ওহে যূয়াইনাব!। [আহাদীসুস সহীহাহ ২৪১৪, সহীহুল জামে ৫০২৫]

কেন শিশুদের প্রতি দয়া প্রয়োজন?-

  • মানসিক বিকাশের জন্য – দয়ার আচরণ শিশুর মনে নিরাপত্তা, আত্মবিশ্বাস ও ভালোবাসা গড়ে তোলে।
  • নৈতিক শিক্ষা – শিশুরা যা দেখে তাই শিখে। বাবা-মা ও সমাজ যদি দয়া দেখায়, তারা ভবিষ্যতে মানবিক মানুষ হবে।
  • পারিবারিক বন্ধন দৃঢ়করণ – দয়া ও স্নেহ পরিবারে শান্তি আনে।
  • আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন – শিশুদের প্রতি দয়া করা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়।

শিশুদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের উপায়-

  • স্নেহ ও ভালোবাসা দেওয়া – নিয়মিত আদর করা, মাথায় হাত বুলানো ও তাদের সাথে সময় কাটানো।
  • ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা – ছেলে-মেয়ে বা বড়-ছোট সন্তানের মধ্যে বৈষম্য না করা।
  • সুন্দর কথা বলা – রূঢ় ভাষা ব্যবহার না করে কোমল ভাষায় শিক্ষা দেওয়া।
  • খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া – শিশুরা খেলার মাধ্যমে শিখে। তাই তাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ দেওয়া উচিত।
  • শিক্ষা ও লালন-পালন – দয়া শুধু আবেগ নয়; সঠিক শিক্ষা ও নৈতিক দীক্ষাও এর অংশ।
  • ধৈর্য ধারণ – শিশুরা দুষ্টুমি করবে, ভুল করবে। এগুলোকে ধৈর্য ও দয়া দিয়ে সামলানো প্রয়োজন।

শিশুদের প্রতি দয়া ও সমাজ-

শিশুরা আজকের সমাজের আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। যদি তাদের প্রতি দয়া করা হয়, তারা নৈতিক, মানবিক ও দায়িত্বশীল হয়ে বড় হবে। অন্যদিকে দয়ার অভাব শিশুর মনে হীনমন্যতা, বিদ্বেষ ও অপরাধপ্রবণতা জন্ম দেয়।

শিশুদের অধিকার ও দয়ার সম্পর্ক-

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে— শিশুর নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভালোবাসা নিশ্চিত করতে হবে। ইসলাম ১৪০০ বছর আগে থেকেই এই অধিকার নিশ্চিত করেছে।

  • জীবনের অধিকার – কন্যা শিশু হত্যা ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।
  • শিক্ষার অধিকার – জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম ছেলে-মেয়ের জন্য ফরজ।
  • খাদ্য ও স্বাস্থ্য – হালাল খাদ্য, নিরাপদ আশ্রয় ও চিকিৎসা দান করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব।
  • ভালোবাসা ও দয়া – শিশুদেরকে মানসিক শান্তি ও স্নেহ প্রদান তাদের মৌলিক অধিকার।

আধুনিক সমাজে শিশুদের প্রতি দয়ার সংকট-

আজকের যুগে প্রযুক্তি, ব্যস্ততা ও পারিবারিক ভাঙনের কারণে অনেক শিশুই দয়া ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা একাকিত্বে ভোগে, মোবাইল ও ইন্টারনেটে আসক্ত হয়, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়।

সমাধান হলো:

  • পরিবারের সবাইকে শিশুর সাথে সময় কাটাতে হবে।
  • শিশুদের জন্য দীনী ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  • স্কুল, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
  • শিশুদের সাথে সহিংসতা ও অবহেলা বন্ধ করতে হবে।

ইসলামের আলোকে শিশুদের প্রতি দয়ার ফলাফল-

শিশুদের প্রতি দয়া করলে যেসব সুফল পাওয়া যায়:

  • পরিবারে শান্তি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
  • শিশুরা দয়ালু ও নৈতিক মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠে।
  • সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়।
  • আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়।

উপসংহার-

শিশুদের প্রতি দয়া শুধু একটি সামাজিক কাজ নয়, এটি ধর্মীয়, নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। নবী করীম ﷺ শিশুদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে আমাদের জন্য একটি আদর্শ রেখে গেছেন। আজকের সমাজে যদি বাবা-মা, পরিবার ও রাষ্ট্র শিশুদের প্রতি দয়া নিশ্চিত করতে পারে, তবে একটি নৈতিক, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজ গড়ে উঠবে।

শিশুদের প্রতি দয়া সম্পর্কিত প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১: ইসলামে শিশুদের প্রতি দয়া দেখানোর গুরুত্ব কী?
উত্তর: ইসলামে শিশুদের প্রতি দয়া করা ঈমানের অংশ। নবী ﷺ বলেছেন, ছোটদের প্রতি দয়া না করলে সে উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

প্রশ্ন ২: শিশুদের সাথে কিভাবে দয়া করা উচিত?
উত্তর: স্নেহ, ন্যায়পরায়ণতা, শিক্ষা, কোমল ভাষা, খেলাধুলার সুযোগ ও ধৈর্যের সাথে আচরণ করা উচিত।

প্রশ্ন ৩: শিশুদের অধিকার ও দয়ার মধ্যে সম্পর্ক কী?
উত্তর: শিশুদের অধিকার যেমন— নিরাপত্তা, শিক্ষা, খাদ্য, ভালোবাসা— সবকিছু দয়ার মাধ্যমেই পূর্ণতা পায়।

প্রশ্ন ৪: দয়ার অভাব শিশুদের উপর কী প্রভাব ফেলে?
উত্তর: দয়ার অভাবে শিশুরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, বিদ্বেষী হয় এবং অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন ৫: আধুনিক যুগে শিশুদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ কী?
উত্তর: প্রযুক্তি আসক্তি, সময়ের অভাব, পারিবারিক ভাঙন ও সহিংসতা শিশুদের দয়ার থেকে বঞ্চিত করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top