শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু: ভূমিকা-
শিশুর সুস্থতা প্রতিটি অভিভাবকের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। তবে ঋতু পরিবর্তনের সময় শিশুদের মধ্যে যে রোগটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা হলো শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু। এটি সাধারণ সর্দি-কাশির মতো হলেও অনেক ক্ষেত্রে গুরুতর জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই শিশুদের ফ্লু সম্পর্কে বিস্তারিত জানা, সময়মতো চিকিৎসা করা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
(নবজাতক শিশুর নিউমোনিয়া: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের সম্পূর্ণ গাইড)
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু কী?-
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু হলো একটি ভাইরাসজনিত সংক্রমণ যা মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। এই ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে এবং জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ তৈরি করে।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লুর কারণ-
শিশুর ফ্লু মূলত ইনফ্লুয়েঞ্জা এ, বি এবং সি ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। এগুলো শিশুদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
- ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
- ভাইরাসযুক্ত বস্তু যেমন খেলনা, কাপড় বা খাবারের সংস্পর্শে এলে শিশুর ফ্লু হতে পারে।
- প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লুর লক্ষণ-
শিশুর ফ্লু প্রথমে সাধারণ সর্দি-কাশির মতো মনে হলেও এর উপসর্গ তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুতর হয়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- হঠাৎ উচ্চ জ্বর
- মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা
- নাক দিয়ে পানি পড়া বা নাক বন্ধ
- গলা ব্যথা ও কাশি
- প্রচণ্ড ক্লান্তি ও দুর্বলতা
- ক্ষুধামান্দ্য
- শিশুদের ক্ষেত্রে বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে
শিশুর ফ্লু ও সাধারণ সর্দি-কাশির মধ্যে পার্থক্য-
অনেক সময় অভিভাবকরা শিশুর ফ্লুকে সাধারণ সর্দি-কাশি ভেবে অবহেলা করেন। তবে কিছু পার্থক্য জানা জরুরি:
- সর্দি-কাশি ধীরে ধীরে শুরু হয়, কিন্তু ফ্লু হঠাৎ করেই উচ্চ জ্বর নিয়ে শুরু হয়।
- সর্দি-কাশিতে হালকা ক্লান্তি হয়, কিন্তু ফ্লুতে শিশুর প্রচণ্ড দুর্বলতা দেখা দেয়।
- ফ্লুতে শরীর ব্যথা ও মাথাব্যথা বেশি হয়।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লুর জটিলতা-
অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রে ফ্লু ৫–৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে:
- নিউমোনিয়া
- কান ইনফেকশন
- সাইনাস ইনফেকশন
- শ্বাসকষ্ট
- অ্যাজমার সমস্যা বেড়ে যাওয়া
বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু ও যারা আগে থেকেই অসুস্থ, তাদের জন্য ফ্লু অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লুর চিকিৎসা-
শিশুর ফ্লুর জন্য সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় না, কারণ এটি ভাইরাসজনিত। তবে চিকিৎসার ধাপগুলো হতে পারে:
- জ্বর নিয়ন্ত্রণ: শিশুকে প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)।
- বিশ্রাম: শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে।
- পানি ও তরল খাবার: শরীরকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করতে বেশি করে পানি, স্যুপ, ফলের রস খাওয়াতে হবে।
- ভাইরাসবিরোধী ওষুধ: গুরুতর অবস্থায় ডাক্তার অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দিতে পারেন।
- হাসপাতালে ভর্তি: শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড জ্বর বা জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
শিশুর ফ্লুর সময়ে করণীয়-
- শিশুকে আলাদা কক্ষে রাখা ভালো।
- হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখতে শেখানো উচিত।
- ঘরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি।
- শিশুর শরীর ঠাণ্ডা রাখা ও হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করানো উপকারী।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু প্রতিরোধ-
শিশুর ফ্লু প্রতিরোধ করা সম্ভব কিছু নিয়ম মেনে চললে:
- প্রতি বছর শিশুকে ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া।
- শিশুকে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করানো।
- ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
- সুষম খাদ্য খাওয়ানো এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
- পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা।
শিশুর ফ্লু ভ্যাকসিন সম্পর্কে জানুন-
ফ্লু প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ফ্লু ভ্যাকসিন।
- ৬ মাস বয়স থেকে শিশুদের ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া যায়।
- এটি বছরে একবার দেওয়া উচিত।
- ভ্যাকসিন শিশুকে গুরুতর জটিলতা থেকে রক্ষা করে।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু নিয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা-
অনেক সময় অভিভাবকরা ভাবেন ফ্লু সাধারণ রোগ এবং তা নিজে নিজে সেরে যাবে। তবে সবসময় তা হয় না। বিশেষ করে নবজাতক ও ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ যেমন – শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, পানিশূন্যতা বা অচেতনভাব দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো জরুরি।
শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: শিশুর ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু কতদিন স্থায়ী হয়?
উত্তর: সাধারণত শিশুর ফ্লু ৫–৭ দিন স্থায়ী হয়। তবে দুর্বলতা ১–২ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
প্রশ্ন ২: শিশুর ফ্লু হলে কি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া উচিত?
উত্তর: না, ফ্লু ভাইরাসজনিত হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। শুধু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজন হলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া যায়।
প্রশ্ন ৩: শিশুর ফ্লুতে কি ডিম বা দুধ খাওয়ানো যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, ডিম, দুধসহ সুষম খাদ্য শিশুকে খাওয়ানো যাবে। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
প্রশ্ন ৪: কোন বয়স থেকে শিশুকে ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া যায়?
উত্তর: ৬ মাস বয়স থেকে ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়া যায় এবং প্রতি বছর একবার তা নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ৫: শিশুর ফ্লু হলে কখন ডাক্তার দেখানো জরুরি?
উত্তর: যদি শিশুর শ্বাসকষ্ট, অচেতনভাব, বারবার খিঁচুনি, প্রচণ্ড জ্বর বা পানিশূন্যতা দেখা দেয় তবে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত।