শিশুর টাইফয়েড: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও সঠিক চিকিৎসা জানুন

শিশুর টাইফয়েড কী?-

শিশুর টাইফয়েড হলো Salmonella Typhi নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ, যা সাধারণত দূষিত পানি বা খাদ্যের মাধ্যমে শিশুর দেহে প্রবেশ করে। এই রোগটি মূলত পাচনতন্ত্রে প্রভাব ফেলে এবং তীব্র জ্বর, পেটব্যথা, দুর্বলতা, ও খাবারে অনীহা তৈরি করে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই রোগটি বেশ সাধারণ কারণ এখানে এখনো অনেক জায়গায় বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের অভাব রয়েছে।

শিশুর টাইফয়েডের কারণ-

শিশুর টাইফয়েড মূলত ঘটে Salmonella Typhi ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হলে। এই ব্যাকটেরিয়া দূষিত খাবার, পানি বা অন্য কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে দেহে প্রবেশ করতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ কারণ তুলে ধরা হলো—

  • বিশুদ্ধ পানি না খাওয়া
  • অপরিষ্কার বা আধা রান্না করা খাবার খাওয়া
  • অসুস্থ ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিস (চামচ, প্লেট, তোয়ালে) ব্যবহার করা
  • অপর্যাপ্ত হাত ধোয়ার অভ্যাস
  • স্বাস্থ্যবিধি না মেনে খাবার প্রস্তুত করা

শিশুর টাইফয়েডের লক্ষণ-

শিশুর টাইফয়েডের লক্ষণ অনেক সময় সাধারণ জ্বর বা ভাইরাল ইনফেকশনের মতো মনে হয়। তবে কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে যা টাইফয়েডকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে।

  • উচ্চ জ্বর (৩৯°C বা তার বেশি)
  • মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা
  • ক্ষুধামান্দ্য বা খাবারে অনীহা
  • বমি বমি ভাব বা বমি
  • পেটব্যথা ও ডায়রিয়া বা কখনও কোষ্ঠকাঠিন্য
  • ত্বকে হালকা লালচে দাগ (rose spots)
  • অতিরিক্ত দুর্বলতা ও ঘাম

যদি শিশুর জ্বর তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয় এবং অন্য কোনো কারণ না থাকে, তবে টাইফয়েড টেস্ট করা জরুরি।

শিশুর টাইফয়েড নির্ণয়-

শিশুর টাইফয়েড শনাক্ত করতে চিকিৎসক সাধারণত কয়েকটি পরীক্ষা করে থাকেন—

  • Widal Test: সবচেয়ে প্রচলিত রক্ত পরীক্ষা যা টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি যাচাই করে।
  • Typhidot Test: দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়, এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
  • Blood Culture: ব্যাকটেরিয়া নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করার সবচেয়ে নির্ভুল পরীক্ষা।
  • Stool/Urine Culture: কখনও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি যাচাই করতে ব্যবহৃত হয়।

শিশুর টাইফয়েডের চিকিৎসা-

শিশুর টাইফয়েডের চিকিৎসা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে করা হয়। তবে ওষুধের ধরণ ও ডোজ শিশুর বয়স, ওজন এবং সংক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।

চিকিৎসা চলাকালে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানা প্রয়োজন—

  • শিশুকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন
  • বেশি করে পানি, স্যুপ, ডাবের পানি, জুস ইত্যাদি তরল খাবার দিন
  • তৈলাক্ত ও মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করুন
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়াবেন না
  • সম্পূর্ণ কোর্স শেষ না করে ওষুধ বন্ধ করবেন না

টাইফয়েড সঠিকভাবে চিকিৎসা না করলে তা লিভার, অন্ত্র ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

শিশুর টাইফয়েডে কী খাওয়া উচিত-

টাইফয়েডে আক্রান্ত শিশুর খাদ্যতালিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুর পাচনতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই হালকা ও সহজপাচ্য খাবার দিতে হবে।

  • ভাত বা নরম খিচুড়ি
  • স্যুপ (সবজি, মুরগি বা ডাল স্যুপ)
  • সেদ্ধ ডিম
  • ফলের রস বা ডাবের পানি
  • আলু ও গাজরের সেদ্ধ

যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলবেন:

  • মশলাযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার
  • সফট ড্রিংকস বা ঠান্ডা পানীয়
  • কাঁচা খাবার ও রাস্তার খাবার

শিশুর টাইফয়েড প্রতিরোধ-

শিশুর টাইফয়েড প্রতিরোধ সম্ভব যদি আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি—

  • শিশুকে বিশুদ্ধ পানি পান করান
  • খাবার ঢেকে রাখুন ও পরিষ্কার স্থানে রাখুন
  • হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন (বিশেষ করে খাবার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পর)
  • শিশুর আশপাশ পরিষ্কার রাখুন
  • টাইফয়েড ভ্যাকসিন প্রয়োগ করুন (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)

ভ্যাকসিন ২ বছর বয়সের পর থেকেই দেওয়া যায় এবং এটি শিশুকে দীর্ঘ সময় টাইফয়েড সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।

শিশুর টাইফয়েডে সম্ভাব্য জটিলতা-

সময়মতো চিকিৎসা না করলে টাইফয়েড শিশুর শরীরে মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে—

  • অন্ত্রের ক্ষতি বা ছিদ্র (intestinal perforation)
  • রক্তপাত
  • লিভার বা প্লীহার প্রদাহ
  • দীর্ঘস্থায়ী জ্বর বা রিল্যাপস
  • পানিশূন্যতা ও দুর্বলতা

শিশুর টাইফয়েডে কখন ডাক্তার দেখাবেন?-

-শিশুর জ্বর যদি ৩ দিনের বেশি থাকে এবং জ্বর কমে না,
-খাবার খেতে না চায় বা বমি করে,
-অতিরিক্ত দুর্বল দেখায়, অথবা মলত্যাগে রক্ত দেখা যায়,
তাহলে দ্রুত শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।

শিশুর টাইফয়েডে ঘরোয়া যত্ন-

ডাক্তারের চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া যত্ন শিশুর দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করতে পারে—

  • শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন
  • গরম পানি দিয়ে মুখ ও হাত ধুতে দিন
  • নিয়মিত শরীর মুছে দিন যাতে শরীর ঠান্ডা থাকে
  • হালকা খাবার দিন এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক খাবারে ফিরিয়ে আনুন

শিশুর টাইফয়েডে ভ্যাকসিনের ভূমিকা-

টাইফয়েড প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ভ্যাকসিন।
বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি ভ্যাকসিন প্রচলিত—

  • Typhoid Conjugate Vaccine (TCV): এটি ২ বছর বয়সের পর থেকে দেওয়া যায় এবং একবারেই দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয়।
  • Vi Polysaccharide Vaccine: এটি ৫ বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুদের জন্য দেওয়া হয় এবং প্রতি ৩ বছরে একবার পুনরায় নিতে হয়।

শিশুর টাইফয়েডে পিতামাতার করণীয়-

  • শিশুর শরীরে কোনো পরিবর্তন দেখলে অবহেলা করবেন না
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ পরিবর্তন করবেন না
  • পানিশূন্যতা রোধে নিয়মিত পানি বা ওআরএস দিন
  • খাবারে যত্ন নিন এবং বিশুদ্ধতা বজায় রাখুন

উপসংহার-

শিশুর টাইফয়েড একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, তবে অবহেলা করলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং সময়মতো ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই শিশুর জ্বর বা অসুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

প্রশ্নোত্তর-

১. শিশুর টাইফয়েড কিভাবে ছড়ায়?
দূষিত খাবার, পানি বা টাইফয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে শিশুর দেহে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে টাইফয়েড হয়।

২. শিশুর টাইফয়েডের প্রধান লক্ষণ কী?
উচ্চ জ্বর, দুর্বলতা, পেটব্যথা, খাবারে অনীহা, ও বমি হলো শিশুর টাইফয়েডের সাধারণ লক্ষণ।

৩. শিশুর টাইফয়েডে কী খাওয়ানো উচিত?
নরম ও সহজপাচ্য খাবার যেমন খিচুড়ি, স্যুপ, ডাবের পানি, ও ফলের রস খাওয়ানো উচিত।

৪. শিশুর টাইফয়েড সম্পূর্ণ সারতে কতদিন লাগে?
সঠিক চিকিৎসায় সাধারণত ৭-১৪ দিনের মধ্যে টাইফয়েড সারতে পারে, তবে দুর্বলতা কিছুদিন থাকতে পারে।

৫. টাইফয়েড প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কি বাধ্যতামূলক?
হ্যাঁ, টাইফয়েড প্রতিরোধে ভ্যাকসিন অত্যন্ত কার্যকর এবং শিশুদের জন্য তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top