শিশুর পানিশূন্যতা কী এবং কেন এটি গুরুতর সমস্যা?-
শিশুর পানিশূন্যতা হলো শরীরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি ও লবণ না থাকার অবস্থা। শিশুদের শরীর তুলনামূলকভাবে ছোট এবং মেটাবলিজম বেশি হওয়ায় তারা খুব দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে।
পানিশূন্যতা হলে শিশুর শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যেমন:
- শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
- পুষ্টি পরিবহন
- কোষ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্রম
যদি সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
শিশুর পানিশূন্যতার সাধারণ কারণ-
শিশু কেন পানিশূন্যতায় ভোগে, তার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:
- ডায়রিয়া (পাতলা পায়খানা) – শিশুদের পানিশূন্যতার সবচেয়ে বড় কারণ।
- বমি – অতিরিক্ত বমির ফলে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়।
- অতিরিক্ত ঘাম – গরমে শিশুর ঘাম হলে শরীরের তরল বেরিয়ে যায়।
- জ্বর – শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পানি দ্রুত নষ্ট হয়।
- বুকের দুধ বা খাবার কম খাওয়া – পর্যাপ্ত তরল না পেলে শরীর দুর্বল হয়।
- সংক্রমণ – অন্ত্রের সংক্রমণ বা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শিশুর তরল চাহিদা বেড়ে যায়।
শিশুর পানিশূন্যতার লক্ষণ-
শিশুর পানিশূন্যতা বোঝার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ খেয়াল করতে হবে:
লক্ষণ | ব্যাখ্যা |
---|---|
মুখ শুকিয়ে যাওয়া | শিশুর ঠোঁট, মুখ ও জিহ্বা শুষ্ক হবে |
প্রস্রাব কম হওয়া | দিনে স্বাভাবিকের তুলনায় কম প্রস্রাব করবে, রঙ গাঢ় হতে পারে |
চোখ বসে যাওয়া | চোখ ঢুকে যাওয়া পানিশূন্যতার গুরুতর লক্ষণ |
কাঁদলে চোখে পানি না আসা | শরীরে তরল ঘাটতির সংকেত |
শিশুর উদাসীনতা | শিশু অলস, ক্লান্ত ও বিরক্ত দেখাবে |
মাথার ফন্টানেল বসে যাওয়া | নবজাতকের মাথার নরম অংশ ভেতরে ঢুকে যাবে |
ওজন হ্রাস | শরীর থেকে পানি কমে গিয়ে ওজন হঠাৎ কমতে পারে |
শিশুর পানিশূন্যতা কমানোর উপায়-
শিশুর পানিশূন্যতা হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
- ওআরএস (ORS) খাওয়ান
-পাতলা পায়খানা হলে সাথে সাথে ওআরএস খাওয়াতে হবে।
-দোকানে সহজলভ্য ওআরএস সলিউশন ব্যবহার করুন।
-ঘরে তৈরি ওআরএস (এক লিটার ফুটানো ঠান্ডা পানিতে ৬ চা-চামচ চিনি ও আধা চা-চামচ লবণ মিশিয়ে) খাওয়ানো যেতে পারে।
- বারবার তরল দিন
-বুকের দুধ খাওয়ান।
-বড় শিশুদের ক্ষেত্রে স্যুপ, ডাবের পানি বা ভাতের মাড় দিতে পারেন।
- খাদ্য চালিয়ে যান
-ডায়রিয়া হলেও শিশু খাওয়া বন্ধ করবেন না।
-সহজপাচ্য খাবার যেমন ভাত, আলু, কলা, ডিমের কুসুম দিন।
- ডাক্তারের পরামর্শ নিন
-যদি পানিশূন্যতা গুরুতর হয় তবে শিশুকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
শিশুর পানিশূন্যতা প্রতিরোধের উপায়-
- জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত কেবল মায়ের দুধ খাওয়ান।
- ডায়রিয়া হলে দ্রুত ওআরএস শুরু করুন।
- শিশুকে পরিষ্কার পানি ও খাবার দিন।
- গরমে শিশুকে ঘরে রাখুন, অতিরিক্ত গরমে বাইরে বের করবেন না।
- হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বিশেষ করে খাবার খাওয়ানোর আগে।
- শিশুকে টিকা দিন (রোটাভাইরাস, কলেরা ইত্যাদি) যাতে ডায়রিয়ার ঝুঁকি কমে।
শিশুর পানিশূন্যতার জটিলতা-
যদি শিশুর পানিশূন্যতা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা দিতে পারে:
- শক (shock)
- কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া
- খিঁচুনি (seizures)
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
- মৃত্যু
তাই যেকোনো ধরনের পানিশূন্যতা অবহেলা করা একেবারেই উচিত নয়।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?-
নিচের অবস্থাগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে:
- শিশু খাওয়া-দাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেয়
- প্রস্রাব একেবারেই হচ্ছে না
- চোখ ও মাথার ফন্টানেল বসে গেছে
- অতি দুর্বল বা অচেতন হয়ে পড়েছে
- বমি বা পাতলা পায়খানা অব্যাহত রয়েছে
উপসংহার-
শিশুর পানিশূন্যতা একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা, তবে সচেতন থাকলে সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। মায়ের দুধ খাওয়ানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, ওআরএস ব্যবহার করা এবং সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ নিলে শিশুকে সুস্থ রাখা সম্ভব।
শিশুর যত্নে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো প্রাথমিক লক্ষণ চিহ্নিত করা এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। এভাবে আমরা আমাদের শিশুদের প্রাণঘাতী ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারি।
শিশুর পানিশূন্যতা নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: শিশুর পানিশূন্যতার প্রধান কারণ কী?
উত্তর: শিশুর পানিশূন্যতার প্রধান কারণ হলো ডায়রিয়া এবং বমি। এছাড়াও জ্বর ও অতিরিক্ত ঘাম থেকেও হতে পারে।
প্রশ্ন ২: পানিশূন্যতা হলে শিশুকে কী খাওয়াতে হবে?
উত্তর: ওআরএস, বুকের দুধ, স্যুপ, ভাতের মাড় এবং ডাবের পানি খাওয়ানো যেতে পারে।
প্রশ্ন ৩: নবজাতকের পানিশূন্যতা কীভাবে বুঝব?
উত্তর: নবজাতকের মুখ শুকিয়ে গেলে, প্রস্রাব কম হলে, চোখ বসে গেলে এবং মাথার ফন্টানেল ভেতরে ঢুকে গেলে পানিশূন্যতা বোঝা যায়।
প্রশ্ন ৪: শিশুর পানিশূন্যতা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় কী?
উত্তর: জন্ম থেকে ৬ মাস পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং, পরিষ্কার খাবার-পানি এবং ওআরএস ব্যবহারই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
প্রশ্ন ৫: পানিশূন্যতা হলে কখন হাসপাতালে নিতে হবে?
উত্তর: যদি শিশু একেবারে খেতে না চায়, অচেতন হয়, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় বা ডায়রিয়া ও বমি অব্যাহত থাকে তবে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।