শিশুর পেটে গ্যাস: ভূমিকা-
প্রতিটি মা-বাবার জন্য শিশুর সুস্থতা সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়। জন্মের পর শিশুর কান্না, খাওয়া, ঘুম, মলত্যাগ সবকিছুই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে অনেক সময় শিশুর অতিরিক্ত কান্না ও অস্বস্তির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় শিশুর পেটে গ্যাস। এটি একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর সমস্যা, যা নবজাতক থেকে শুরু করে ছয় মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
যদিও গ্যাস কোনো গুরুতর অসুস্থতা নয়, তবে এটি শিশুর অস্বস্তি তৈরি করে এবং মা-বাবাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। সঠিক তথ্য জানলে এবং সময়মতো যত্ন নিলে এই সমস্যা সহজেই মোকাবিলা করা যায়।
শিশুর পেটে গ্যাস কেন হয়?-
শিশুর পরিপাকতন্ত্র জন্মের পরও পুরোপুরি পরিণত হয় না। ফলে খাবার হজমের সময় গ্যাস জমে যাওয়া স্বাভাবিক। নিচে প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো—
১. দুধ খাওয়ার সময় বাতাস ঢুকে যাওয়া
- নবজাতক দুধ খাওয়ার সময় প্রায়ই বাতাস গিলে ফেলে।
- বিশেষ করে বোতলে খাওয়ানো হলে গ্যাস জমে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
২. বুকের দুধের অতিরিক্ত প্রবাহ
- অনেক সময় মায়ের দুধ দ্রুত প্রবাহিত হলে শিশুর শ্বাসের সাথে বাতাস চলে যায়।
- এতে শিশুর পেটে গ্যাস তৈরি হয়।
৩. অপরিণত হজম প্রক্রিয়া
- শিশুর অন্ত্র সম্পূর্ণ বিকশিত না থাকায় খাবার সঠিকভাবে হজম হয় না।
- ফলে গ্যাসের প্রবণতা বাড়ে।
৪. মায়ের খাবারের প্রভাব
- মায়ের খাওয়া কিছু খাবার (যেমন ডাল, বাঁধাকপি, মসুর, দুধজাত খাবার) শিশুর পেটে গ্যাস তৈরি করতে পারে।
৫. কৃত্রিম দুধ বা ফর্মুলা
- ফর্মুলা দুধ হজমে সময় বেশি লাগে।
- এতে শিশুর পেটে গ্যাস জমতে পারে।
৬. অ্যালার্জি বা ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা
- কিছু শিশুর ক্ষেত্রে দুধের ল্যাকটোজ হজমে সমস্যা হয়।
- এর ফলে গ্যাস, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।
শিশুর পেটে গ্যাসের লক্ষণ-
মা-বাবা প্রায়ই বুঝতে পারেন না শিশুর অস্বস্তির কারণ। নিচের লক্ষণগুলো শিশুর পেটে গ্যাসের উপস্থিতি বোঝাতে পারে—
- শিশুর অতিরিক্ত কান্না, বিশেষ করে খাওয়ার পর
- পা মোচড়ানো বা পেট শক্ত করে ধরা
- ঘুম ভেঙে কান্না করা
- মুখ লাল হয়ে যাওয়া
- বুক ফেঁপে ওঠা
- ঘন ঘন ঢেঁকুর তোলা
- পায়ুপথ দিয়ে গ্যাস নির্গমন
- পেট শক্ত বা ফুলে যাওয়া
যদি এসব লক্ষণ নিয়মিত দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে শিশুর পেটে গ্যাস জমছে।
শিশুর পেটে গ্যাসের সম্ভাব্য ঝুঁকি-
যদিও এটি বড় ধরনের অসুখ নয়, তবে অবহেলা করলে কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে—
- শিশুর ঘুম ব্যাহত হয়
- খাওয়া কমে যায়
- ওজন বাড়তে বাধা পায়
- শিশুর বিরক্তি বাড়ে
- ডিহাইড্রেশন বা অপুষ্টির ঝুঁকি দেখা দেয়
শিশুর পেটে গ্যাস দূর করার ঘরোয়া উপায়-
১. শিশুকে ঢেঁকুর তুলতে সাহায্য করুন
- প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর পর শিশুকে কাঁধে নিয়ে আলতো চাপ দিন।
- এতে গ্যাস বেরিয়ে যাবে।
২. শিশুর পেটে হালকা মালিশ
- কুসুম গরম তেল দিয়ে শিশুর পেটে ঘড়ির কাঁটার দিকে মালিশ করুন।
- এটি হজমে সাহায্য করে ও গ্যাস কমায়।
৩. শিশুর পা সাইকেলের মতো নাড়ানো
- শিশুকে চিত করে শুইয়ে পা দুটো সাইকেলের মতো নাড়াতে থাকুন।
- এতে পেটের চাপ কমে গ্যাস বের হয়ে যায়।
৪. গরম পানির সেঁক
- একটি কাপড়ে গরম পানি ভিজিয়ে শিশুর পেটে হালকা সেঁক দিলে আরাম পায়।
৫. বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক ভঙ্গি
- শিশুকে আধশোয়া অবস্থায় দুধ খাওয়ান।
- এতে বাতাস কম ঢোকে এবং গ্যাস জমে না।
৬. ফর্মুলা ফিডিংয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা
- বোতল খাওয়ানোর সময় সবসময় নিশ্চিত করুন নিপলের ভেতর ফাঁপা বাতাস না থাকে।
শিশুর পেটে গ্যাস প্রতিরোধের উপায়-
- শুধুমাত্র ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।
- খাওয়ানোর সময় শিশুর মাথা সামান্য উঁচু করে রাখুন।
- মায়ের খাবারে গ্যাস সৃষ্টিকারী খাবার সীমিত রাখুন।
- ফর্মুলা দুধ খাওয়ালে ডাক্তারি পরামর্শে সঠিক ব্র্যান্ড ব্যবহার করুন।
- শিশুর পেট পরিষ্কার রাখুন ও নিয়মিত ব্যায়াম (হালকা নড়াচড়া) করান।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?-
- শিশুর পেটে অতিরিক্ত ফাঁপা ভাব থাকলে
- অতিরিক্ত কান্না বা খাওয়া বন্ধ করে দিলে
- রক্ত বা শ্লেষ্মা সহ মলত্যাগ হলে
- ডায়রিয়া বা জ্বর হলে
- শিশুর ওজন কমতে শুরু করলে
এই পরিস্থিতিতে দ্রুত ডাক্তার দেখানো জরুরি।
উপসংহার-
শিশুর পেটে গ্যাস একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি শিশু ও মা-বাবার জন্য অস্বস্তিকর। কারণটি বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নিলে সহজেই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো, সঠিক ভঙ্গিতে খাওয়ানো, প্রতিবার খাওয়ার পর ঢেঁকুর তোলা, ঘরোয়া যত্ন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা শিশুর গ্যাস কমাতে সহায়ক। তবে অতিরিক্ত সমস্যা বা জটিল লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: শিশুর পেটে গ্যাস হলে কি বিপজ্জনক?
উত্তর: সাধারণত বিপজ্জনক নয়। তবে ঘন ঘন হলে বা অন্য উপসর্গ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
প্রশ্ন ২: বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুর গ্যাস কেন হয়?
উত্তর: দুধ খাওয়ার সময় বাতাস ঢুকে গেলে গ্যাস তৈরি হয়। এছাড়া মায়ের খাবারও প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রশ্ন ৩: শিশুকে কতক্ষণ পরপর ঢেঁকুর তোলা উচিত?
উত্তর: প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর পরই শিশুকে ঢেঁকুর তুলতে সাহায্য করতে হবে।
প্রশ্ন ৪: ঘরোয়া কোন উপায়ে শিশুর গ্যাস কমানো যায়?
উত্তর: শিশুর পেটে তেল মালিশ, পা সাইকেল চালানোর মতো নাড়ানো, গরম পানির সেঁক—এসব খুব কার্যকর।
প্রশ্ন ৫: শিশুর গ্যাস হলে ওষুধ দেওয়া কি প্রয়োজন?
উত্তর: ওষুধ দেওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারি পরামর্শ নিতে হবে। অযথা কোনো ওষুধ খাওয়ানো উচিত নয়।