শিশুর মুখে লালা পড়া – একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া-
শিশুর মুখে লালা পড়া অনেক অভিভাবকের কাছে চিন্তার বিষয় মনে হলেও এটি সাধারণত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। জীবনের প্রথম কয়েক মাসে শিশুদের লালা গ্রন্থি (Salivary Glands) দ্রুত কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু শিশুর গলার পেশি এখনো পুরোপুরি শক্তিশালী না হওয়ায় তারা লালা ঠিকভাবে গিলতে পারে না। ফলে মুখ দিয়ে লালা ঝরে পড়ে।
শিশুর মুখে লালা সাধারণত কবে থেকে শুরু হয়?-
- সাধারণত ২ থেকে ৩ মাস বয়স থেকে শিশুর মুখে লালা পড়া শুরু হয়।
- ৪ থেকে ৬ মাস বয়সে দাঁত ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হলে লালা পড়ার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।
- ১২ থেকে ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত অনেক শিশুর মুখে লালা দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে কমে আসে।
শিশুর মুখে লালা পড়ার কারণ-
শিশুর মুখে লালা পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো:
- দাঁত ওঠা – দাঁত ওঠার সময় শিশুর মাড়িতে চুলকানি হয়, ফলে তারা জিনিস কামড়াতে থাকে এবং লালার প্রবাহ বেড়ে যায়।
- অপরিণত গলার পেশি – ছোট শিশুরা এখনো লালা গিলতে শিখে না, তাই মুখ দিয়ে ঝরে যায়।
- বৃদ্ধি ও বিকাশ – লালা খাবার হজমে সাহায্য করে, তাই শিশু যখন নতুন খাবারের জন্য প্রস্তুত হয় তখনও লালা বেড়ে যায়।
- মুখে জিনিস দেওয়া অভ্যাস – শিশুরা খেলনা বা আঙুল মুখে দেয়, এতে লালার উৎপাদন বাড়ে।
- সংক্রমণ বা অসুস্থতা – কখনো কখনো গলা ব্যথা, ঠান্ডা বা সংক্রমণের কারণেও লালা বেশি হতে পারে।
শিশুর মুখে লালা পড়া – স্বাভাবিক নাকি সমস্যার লক্ষণ?-
বেশিরভাগ সময়ই শিশুর মুখে লালা পড়া স্বাভাবিক। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি স্বাস্থ্য সমস্যার সংকেত হতে পারে:
- লালার সাথে কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট থাকলে
- লালা পড়া হঠাৎ অনেক বেড়ে গেলে
- শিশুর খাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে
- লালা ঘন হয়ে গেলে
- শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
শিশুর মুখে লালা পড়ার সম্ভাব্য সমস্যা-
- চামড়ায় র্যাশ – লালা ঘাড়, গাল ও বুকে পড়লে ত্বক লাল ও ফুসকুড়ি হতে পারে।
- অসুবিধা সৃষ্টি – শিশুর জামাকাপড় ভিজে অস্বস্তি হতে পারে।
- সংক্রমণের ঝুঁকি – মুখে খেলনা ও হাত দেওয়ার কারণে জীবাণু শরীরে ঢোকার সম্ভাবনা বাড়ে।
শিশুর মুখে লালা পড়া কমানোর উপায়-
- বিব বা কাপড় ব্যবহার করুন
– নরম তুলার বিব (bib) ব্যবহার করলে জামা ভিজে যাবে না।
– প্রয়োজনে দিনে কয়েকবার পরিবর্তন করুন।
- ত্বক পরিষ্কার রাখুন
-মুখ ও গলা নিয়মিত নরম কাপড় দিয়ে মুছে শুকনো রাখুন।
-বেবি লোশন বা পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করে র্যাশ প্রতিরোধ করুন।
- খেলনা ও টিথার ব্যবহার করুন
-শিশুকে নিরাপদ টিথার বা সিলিকন খেলনা দিন, এতে দাঁতের ব্যথা কমবে এবং মুখে হাত দেওয়ার প্রবণতা কমবে।
- পানিশূন্যতা রোধ করুন
-লালার কারণে শরীর থেকে কিছু তরল বের হয়, তাই পর্যাপ্ত বুকের দুধ বা পানি (৬ মাসের পর) দিন।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
-খেলনা নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
-শিশুর হাত ধোয়া নিশ্চিত করুন।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?-
- লালার সাথে জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে
- শিশু খাওয়া বন্ধ করলে
- লালা সবসময় গলা আটকে শ্বাস নিতে কষ্ট হলে
- লালা অস্বাভাবিক ঘন বা রক্ত মেশানো হলে
এক্ষেত্রে অবিলম্বে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন।
শিশুর মুখে লালা ও দাঁত ওঠা-
শিশুর দাঁত ওঠার সময় মুখে লালা পড়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দাঁত ওঠার অন্যান্য লক্ষণগুলো হলো:
- মাড়ি ফুলে যাওয়া
- খাবারে অনীহা
- জিনিস কামড়ানোর প্রবণতা
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
এই সময়ে শিশুকে নিরাপদ টিথার, ঠান্ডা চামচ বা পরিষ্কার কাপড় চিবানোর সুযোগ দিলে স্বস্তি পায়।
শিশুর মুখে লালা পড়া নিয়ে অভিভাবকের করণীয়-
- আতঙ্কিত হবেন না – এটি সাধারণত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
- শিশুর স্বাস্থ্যের পরিবর্তন লক্ষ্য করুন।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ যত্ন নিন।
- সন্দেহ হলে বা অন্য লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।
উপসংহার-
শিশুর মুখে লালা পড়া সাধারণত একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এটি শিশুর বৃদ্ধি ও দাঁত ওঠার অংশ হিসেবেই ঘটে। তবে যদি এর সাথে অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় তবে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিয়মিত যত্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সতর্কতা অবলম্বন করলে শিশুর অস্বস্তি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
শিশুর মুখে লালা নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: শিশুর মুখে লালা কেন পড়ে?
উত্তর: দাঁত ওঠা, অপরিণত গলার পেশি এবং প্রাকৃতিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার কারণে শিশুর মুখে লালা পড়ে।
প্রশ্ন ২: লালা পড়া কি স্বাভাবিক?
উত্তর: হ্যাঁ, জীবনের প্রথম ১২-১৮ মাস পর্যন্ত শিশুর মুখে লালা পড়া স্বাভাবিক বিষয়।
প্রশ্ন ৩: শিশুর মুখে লালা পড়া কি দাঁত ওঠার লক্ষণ?
উত্তর: হ্যাঁ, দাঁত ওঠার সময় শিশুর মুখে লালা বেশি দেখা যায়।
প্রশ্ন ৪: লালা পড়া কমানোর উপায় কী?
উত্তর: বিব ব্যবহার করা, ত্বক শুকনো রাখা, টিথার দেওয়া এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে লালা পড়া কমানো যায়।
প্রশ্ন ৫: কখন ডাক্তার দেখানো উচিত?
উত্তর: যদি লালার সাথে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট বা খাওয়ার অনীহা থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো উচিত।