সি-সেকশন কি?

সি-সেকশন কি?- সিজারিয়ান ডেলিভারি প্রক্রিয়া, কারণ, ঝুঁকি ও প্রয়োজনীয় তথ্য

সি-সেকশন কি?-

সি-সেকশন বা সিজারিয়ান ডেলিভারি হলো একটি সার্জিক্যাল প্রসব প্রক্রিয়া, যেখানে মায়ের পেট ও জরায়ু কেটে শিশুকে বের করা হয়। সাধারণত যখন প্রাকৃতিক প্রসব (Normal Delivery) ঝুঁকিপূর্ণ বা অসম্ভব হয়, তখন চিকিৎসকরা সি-সেকশন করার পরামর্শ দেন।

এই পদ্ধতিটি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, যা মা ও শিশুর জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রায় ৩০% প্রসবই সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে।

 সি-সেকশন কেন করা হয়?-

সি-সেকশন সবসময় চিকিৎসকের সিদ্ধান্তে করা হয়। অনেক সময় মায়ের বা শিশুর জীবন রক্ষার জন্যই এটি একমাত্র নিরাপদ উপায় হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত নিচের কারণগুলোতে সি-সেকশন করা হয়ঃ

  • শিশুর অবস্থান ভুল হলে — যেমন, শিশুর পা আগে আছে (Breech position)।
  • শিশুর হার্টবিট অস্বাভাবিক হলে।
  • মায়ের জরায়ু বা পেলভিস ছোট হলে।
  • আগের প্রসব সিজারিয়ান হলে।
  • জরায়ু বা প্লাসেন্টায় সমস্যা থাকলে।
  • মায়ের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে।
  • প্রসবের সময় দীর্ঘায়িত হলে বা ব্যথা সহ্য না হলে।
  • শিশুর নাভির জট পাকানো থাকলে।

সি-সেকশন প্রক্রিয়া কেমন হয়?-

সি-সেকশন একটি পরিকল্পিত সার্জারি। তবে কখনো কখনো হঠাৎ করেও করা হয় (Emergency C-section)।

প্রক্রিয়া ধাপসমূহঃ

  • অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয় — সাধারণত স্পাইনাল বা এপিডিউরাল অ্যানেস্থেসিয়া।
  • পেট পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা হয়।
  • ডাক্তার নিচের পেটে কেটে জরায়ু পর্যন্ত পৌঁছান।
  • শিশুকে ধীরে ধীরে বের করা হয়।
  • শিশুর নাড়ি কাটা ও নবজাতককে সেবাদান করা হয়।
  • জরায়ু ও পেট সেলাই করে বন্ধ করা হয়।

পুরো প্রক্রিয়াটি সাধারণত ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়।

 সি-সেকশন ও নরমাল ডেলিভারির পার্থক্য-

বিষয় নরমাল ডেলিভারি সি-সেকশন
প্রসব পদ্ধতি প্রাকৃতিকভাবে শিশুর জন্ম সার্জারির মাধ্যমে শিশুর জন্ম
সময় ৬-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা
ব্যথা প্রসবের সময় তীব্র ব্যথা অপারেশনের পর ব্যথা থাকে
পুনরুদ্ধার দ্রুত সুস্থ হওয়া যায় সুস্থ হতে সময় লাগে
ঝুঁকি কম অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি বেশি
খরচ তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল

 সি-সেকশনের ঝুঁকি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া-

যদিও সি-সেকশন অনেক ক্ষেত্রে জীবন রক্ষা করে, তবে এটি একটি বড় অস্ত্রোপচার — ফলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে।

মায়ের ঝুঁকি:

  • ইনফেকশন বা ক্ষতস্থানে পুঁজ হওয়া
  • অতিরিক্ত রক্তপাত
  • ব্যথা বা ফোলাভাব
  • পরবর্তী গর্ভধারণে জটিলতা
  • সেলাইয়ের জায়গায় সমস্যা

শিশুর ঝুঁকি:

  • শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি
  • জন্মের সময় সামান্য কাটাছেঁড়া
  • প্রিম্যাচিউর জন্ম হলে শ্বাস-প্রশ্বাস সমস্যা

সি-সেকশন পর যত্ন নেওয়া কিভাবে করবেন-

সি-সেকশন শেষে মায়ের জন্য বিশেষ যত্ন প্রয়োজন।
নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়া হলোঃ

  • বিশ্রাম নিন — অন্তত ৪-৬ সপ্তাহ বিশ্রাম জরুরি।
  • পানি ও তরল খাবার খান — শরীরের পানি ও পুষ্টি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
  • ক্ষতস্থান পরিষ্কার রাখুন — ইনফেকশন এড়াতে প্রতিদিন হালকা করে পরিষ্কার করুন।
  • ওষুধ সময়মতো নিন — ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ও অ্যান্টিবায়োটিক।
  • ভারী কাজ এড়িয়ে চলুন — ৬ সপ্তাহের আগে ভারী কিছু তুলবেন না।
  • শিশুকে বুকের দুধ দিন — সিজারিয়ান মায়েদেরও বুকের দুধ দেওয়া নিরাপদ।

 সি-সেকশনের পর শিশুর যত্ন-

  • শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ দিন।
  • জন্মের পর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • টিকা সময়মতো দিন।
  • ঘুম ও খাওয়ার সময়সূচি ঠিক রাখুন।

 সি-সেকশন কি নিরাপদ প্রসব পদ্ধতি?-

হ্যাঁ, সঠিক সময়ে ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সি-সেকশন একটি নিরাপদ পদ্ধতি। তবে অপ্রয়োজনে সি-সেকশন করা উচিত নয়, কারণ এটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, প্রতি দেশে মোট প্রসবের মধ্যে ১৫% এর বেশি সি-সেকশন হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে এই হার ৩৫% ছাড়িয়েছে, যা উদ্বেগজনক।

 সি-সেকশন সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণা-

  • “সি-সেকশন মানেই দুর্বল মা” — এটি ভুল। কখনো কখনো এটি জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত।
  • “সি-সেকশন করা মানে শিশুর সমস্যা” — না, যথাযথ চিকিৎসা থাকলে ঝুঁকি কম।
  • “সি-সেকশন মায়েরা দুধ দিতে পারেন না” — এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।

 সি-সেকশন কখন জরুরি হয়ে পড়ে-

নিচের অবস্থাগুলিতে সি-সেকশন জরুরি হয়ঃ

  • শিশুর হার্টবিট হঠাৎ কমে গেলে
  • রক্তপাত বেড়ে গেলে
  • মায়ের প্রসব ব্যথা দীর্ঘায়িত হলে
  • জরায়ু ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে
  • প্লাসেন্টা নিচে অবস্থান করলে (Placenta previa)

চিকিৎসকের পরামর্শ কেন জরুরি-

সি-সেকশন করা বা না করা — এ সিদ্ধান্ত কখনই নিজে নেওয়া উচিত নয়। এটি চিকিৎসক, গাইনোকোলজিস্ট এবং এনেস্থেসিওলজিস্টের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে হওয়া উচিত।
ডাক্তার মায়ের স্বাস্থ্য, শিশুর অবস্থা ও ঝুঁকি বিবেচনা করেই সঠিক পদক্ষেপ নেন।

সি-সেকশন পর মানসিক যত্ন-

অপারেশনের পর অনেক মা মানসিকভাবে দুর্বল বা হতাশ বোধ করেন। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

  • পরিবার ও স্বামীর সহযোগিতা জরুরি।
  • নিজের শরীরকে সময় দিন।
  • শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন।
  • প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং নিন।

উপসংহার-

সি-সেকশন কি — এই প্রশ্নের উত্তর হলো, এটি একটি আধুনিক ও জীবনরক্ষাকারী প্রসব পদ্ধতি, যা অনেক মায়ের ও নবজাতকের জীবন বাঁচায়। তবে অপ্রয়োজনে সি-সেকশন না করে, চিকিৎসকের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ

প্রতিটি গর্ভধারণ আলাদা, তাই নিজের শরীর, মানসিক অবস্থা ও শিশুর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিন। মনে রাখবেন, মায়ের সুস্থতাই শিশুর সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।

প্রশ্নোত্তর-

১. সি-সেকশন কি সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ?

না, চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণে এবং সঠিক প্রস্তুতিতে এটি নিরাপদ প্রসব পদ্ধতি।

২. সি-সেকশনের পর কতদিনে স্বাভাবিক হওয়া যায়?

সাধারণত ৬ সপ্তাহের মধ্যে মায়েরা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

৩. সি-সেকশনের পর আবার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব?

হ্যাঁ, যদি জরায়ু ও দেহ সুস্থ থাকে, অনেক সময় পরবর্তী গর্ভে নরমাল ডেলিভারিও সম্ভব।

৪. সি-সেকশন করলে কি বুকের দুধ দেওয়া যায়?

অবশ্যই যায়। সিজারিয়ান মায়েদের জন্য বুকের দুধ দেওয়া নিরাপদ ও জরুরি।

৫. সি-সেকশন কি আগেই ঠিক করে করা যায়?

হ্যাঁ, যেসব ক্ষেত্রে ঝুঁকি জানা থাকে, ডাক্তাররা নির্ধারিত তারিখে পরিকল্পিত (Planned C-section) করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top