শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য: অভিভাবকের দুশ্চিন্তার নাম-
প্রতিটি অভিভাবকের কাছে শিশুর সুস্থতা ও সঠিক বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। তবে অনেক সময় দেখা যায় শিশুর হজমে সমস্যা হচ্ছে এবং সে নিয়মিত মলত্যাগ করছে না। একে আমরা বলি শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য। এটি শিশুর জন্য অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা তৈরি করে এবং অভিভাবকদের চিন্তিত করে তোলে। বিশেষ করে নবজাতক ও ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য কী?-
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে শিশুর মল শক্ত, শুকনো বা কম ঘন ঘন হয়, এবং মলত্যাগের সময় সে কষ্ট অনুভব করে। সুস্থ শিশুদের মলত্যাগের হার বিভিন্ন হতে পারে। কেউ দিনে ২–৩ বার করে, আবার কেউ ২–৩ দিনে একবার মলত্যাগ করে। তবে মূল বিষয় হলো মল নরম এবং সহজে বের হওয়া। যদি মল শক্ত, শুকনো বা শিশুর অস্বস্তির কারণ হয়, তখনই এটি কোষ্ঠকাঠিন্য ধরা হয়। নিচে একটি ছোট তালিকা তুলে ধরা হলো:
বিষয় | ব্যাখ্যা | প্রতিকার |
---|---|---|
কারণ | ফর্মুলা দুধ, পানির অভাব, ফাইবারের ঘাটতি, খাবারের পরিবর্তন, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া | শিশুর জন্য পর্যাপ্ত তরল, সঠিক ফর্মুলা নির্বাচন, ডাক্তারি পরামর্শ |
লক্ষণ | মল শক্ত ও শুকনো হওয়া, কয়েকদিন মল না হওয়া, মলত্যাগে কষ্ট পাওয়া, পেট ফুলে থাকা, মলদ্বারে রক্ত আসা | শিশুর পেট ম্যাসাজ, হালকা ব্যায়াম, ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া |
প্রতিকার | পর্যাপ্ত পানি খাওয়ানো, শাকসবজি ও ফলমূল যোগ করা, সাইকেল মুভমেন্ট ব্যায়াম, কুসুম গরম পানি খাওয়ানো | মল সহজে বের হতে সহায়তা করা, শিশুকে আরাম দেওয়া |
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ-
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের পেছনে নানা কারণ কাজ করতে পারে। এগুলো জানা থাকলে অভিভাবকরা সহজেই প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পারেন।
- ফর্মুলা দুধ খাওয়া: মায়ের দুধের তুলনায় ফর্মুলা দুধ শিশুদের জন্য কিছুটা জটিলভাবে হজম হয়, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে।
- খাবারের পরিবর্তন: ৬ মাস বয়সের পর যখন কঠিন খাবার শুরু হয়, তখন অনেক শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।
- শরীরে পানির ঘাটতি: পর্যাপ্ত তরল না পেলে মল শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়।
- ফাইবারের ঘাটতি: শিশুর খাবারে ফলমূল ও শাকসবজির অভাব থাকলে হজমে সমস্যা হয়।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়াতে পারে।
- মনস্তাত্ত্বিক কারণ: বড় শিশুদের ক্ষেত্রে মলত্যাগে ভয় বা অস্বস্তি থেকেও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ-
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য চিহ্নিত করা সহজ, যদি কিছু লক্ষণ খেয়াল করা যায়।
- কয়েকদিন মলত্যাগ না হওয়া
- মল শক্ত, শুকনো বা ছোট ছোট বলের মতো হওয়া
- মলত্যাগের সময় শিশুর কান্না বা কষ্ট পাওয়া
- পেট ফুলে থাকা বা শক্ত অনুভূত হওয়া
- শিশুর অস্থিরতা ও ক্ষুধামন্দা
- মলত্যাগের সময় রক্ত আসা (অতিরিক্ত চাপের কারণে)
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি ও প্রভাব-
যদি শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
- অসুবিধাজনক হজম প্রক্রিয়া
- শিশুর অস্বস্তি ও কান্না
- ক্ষুধামন্দা ও অপুষ্টি
- মলদ্বারে আঘাত বা ফাটল
- মানসিক ভয় বা অস্বস্তি
তাই শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যকে অবহেলা না করে শুরুতেই প্রতিকার করা জরুরি।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রতিকার-
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার কিছু কার্যকর উপায় আছে যা অভিভাবকরা সহজেই প্রয়োগ করতে পারেন।
- শিশুকে পর্যাপ্ত তরল দিন: ৬ মাসের বেশি শিশুদের জন্য পানি প্রয়োজন।
- ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন: বড় শিশুদের খাবারে নাশপাতি, আপেল, প্রুন, পেঁপে, শাকসবজি ইত্যাদি রাখুন।
- শিশুকে নাড়াচাড়া করান: হালকা সাইকেল এক্সারসাইজ বা পা নাড়ানো শিশুর অন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে।
- পেট ম্যাসাজ করুন: ঘড়ির কাঁটার মতো দিক ধরে হালকা গরম হাত দিয়ে ম্যাসাজ করলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমে।
- সঠিক ফর্মুলা নির্বাচন করুন: যদি ফর্মুলা দুধে সমস্যা হয়, তবে ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে পরিবর্তন করতে হবে।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের ঘরোয়া সমাধান-
অভিভাবকরা বাড়িতেই কিছু সহজ পদ্ধতিতে শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে পারেন।
- কুসুম গরম পানি খাওয়ানো
- প্রুন বা নাশপাতির জুস খাওয়ানো (বড় শিশুদের জন্য)
- দই বা প্রোবায়োটিক খাবার দেওয়া
- নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলার অভ্যাস তৈরি করা
কবে ডাক্তার দেখানো জরুরি?-
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা জটিলতা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে।
- এক সপ্তাহের বেশি মলত্যাগ না হওয়া
- মলে রক্ত আসা
- অতিরিক্ত কান্না বা অস্থিরতা
- জ্বর, বমি বা ওজন কমে যাওয়া
- শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধের উপায়-
প্রতিরোধ সবসময় চিকিৎসার চেয়ে ভালো। কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য এড়ানো সম্ভব।
- শিশুকে পর্যাপ্ত পানি ও তরল দিন
- খাবারে শাকসবজি ও ফলমূল রাখুন
- শিশুকে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখুন
- ফর্মুলা ব্যবহারের আগে ডাক্তারি পরামর্শ নিন
- নিয়মিত শিশুর পেট ম্যাসাজ করুন
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য ও মায়ের দুধ-
মায়ের দুধ হলো শিশুর জন্য সেরা খাবার। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু মায়ের দুধ খাওয়া শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য সাধারণত হয় না। কারণ মায়ের দুধ সহজে হজম হয় এবং এতে পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টি থাকে। তবে শিশুর মলত্যাগ কম হলেও যদি মল নরম হয়, তবে চিন্তার কিছু নেই।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য ও মানসিক প্রভাব-
অনেক সময় বড় শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা টয়লেটে যেতে ভয় পায় বা অস্বস্তি বোধ করে। এর ফলে তারা মল চেপে রাখে, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুকে ধীরে ধীরে অভ্যাস করানো এবং ভয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য খাদ্য তালিকা-
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে কিছু নির্দিষ্ট খাবার কার্যকর ভূমিকা রাখে।
- নাশপাতি, আপেল, পেঁপে, প্রুন
- গাজর, মিষ্টি কুমড়া, পালং শাক
- দই, প্রোবায়োটিক খাবার
- পর্যাপ্ত পানি ও তরল
অন্যদিকে, অতিরিক্ত দুধজাত খাবার, জাঙ্ক ফুড ও কম ফাইবারযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে অভিভাবকের করণীয়-
- শিশুর ডায়াপার চেক করে মলত্যাগের রুটিন খেয়াল রাখা
- নতুন খাবার খাওয়ানোর পর শরীরের প্রতিক্রিয়া দেখা
- শিশুকে আরামদায়ক পরিবেশে টয়লেটের অভ্যাস করানো
- প্রয়োজনে ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া
সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য কতদিন থাকলে চিন্তার বিষয়?
উত্তর: যদি ৫–৭ দিন মল না হয় বা শিশুর প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে।
প্রশ্ন ২: মায়ের দুধ খাওয়া শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য হয় কি?
উত্তর: খুব কম হয়। মায়ের দুধ সহজে হজম হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি কমায়।
প্রশ্ন ৩: কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে শিশুকে কোন ফল দেওয়া ভালো?
উত্তর: নাশপাতি, প্রুন, আপেল ও পেঁপে শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে কার্যকর।
প্রশ্ন ৪: শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ওষুধ দেওয়া নিরাপদ কি?
উত্তর: ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া শিশুকে কোনো ওষুধ দেওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন ৫: শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা যায় কিভাবে?
উত্তর: পর্যাপ্ত পানি, ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার ও নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে।