বাচ্চার পানিশূন্যতা: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ

 

বাচ্চার পানিশূন্যতা-

শিশুর সুস্থতা নির্ভর করে তার শরীরে পর্যাপ্ত পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষার ওপর। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের স্বাভাবিক কাজকর্মের জন্য পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে নানা কারণে বাচ্চার পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন হতে পারে। ডিহাইড্রেশন সময়মতো সঠিকভাবে চিকিৎসা না করলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা এমনকি জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের মতো উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে শিশুদের মধ্যে পানিশূন্যতা একটি সাধারণ সমস্যা। বিশেষ করে ডায়রিয়া, বমি, জ্বর বা অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে বাচ্চাদের শরীর থেকে দ্রুত পানি বের হয়ে যায়। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নানা জটিলতা দেখা দেয়।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব—বাচ্চার পানিশূন্যতা কী, এর কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ এবং অভিভাবকের করণীয়।

বাচ্চার পানিশূন্যতা কী?-

শরীরে যখন পর্যাপ্ত পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড ইত্যাদি) থাকে না, তখন তাকে পানিশূন্যতা বলা হয়। শিশুর শরীরে পানির পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বেশি থাকে। তাই অল্প সময়েই শিশুদের শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হতে পারে।

বাচ্চার পানিশূন্যতার কারণ-

বাচ্চাদের শরীরে পানিশূন্যতা হওয়ার বেশ কয়েকটি সাধারণ কারণ রয়েছে:

  • ডায়রিয়া
    শিশুদের ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, যা পানিশূন্যতার প্রধান কারণ।
  • বমি
    বারবার বমি হলে শরীরের পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে গিয়ে ডিহাইড্রেশন হয়।
  • জ্বর
    জ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং ঘামের মাধ্যমে পানি বের হয়। এতে শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে।
  • অতিরিক্ত ঘাম
    গরম আবহাওয়ায় খেলাধুলা করলে বাচ্চারা প্রচুর ঘামায়। ফলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া
    অনেক শিশু যথেষ্ট পানি পান করে না। বিশেষ করে অসুস্থ থাকলে বা ক্ষুধা না থাকলে এই সমস্যা আরও বাড়ে।
  • দুধ বা খাবার ঠিকমতো না খাওয়া
    নবজাতক শিশুরা যদি পর্যাপ্ত মায়ের দুধ না পায়, তবে তারাও দ্রুত পানিশূন্যতায় ভুগতে পারে।

বাচ্চার পানিশূন্যতার লক্ষণ-

বাচ্চার পানিশূন্যতা বোঝার জন্য কিছু সাধারণ লক্ষণ জানা জরুরি।

  • বারবার কান্না করা কিন্তু চোখে পানি না আসা
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হওয়া
  • ঠোঁট ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া
  • চোখ ঢেবে যাওয়া
  • চামড়া টেনে ধরলে সহজে স্বাভাবিক অবস্থায় না ফেরা
  • অবসন্ন ও দুর্বল হয়ে যাওয়া
  • অতিরিক্ত ঘুমানো বা বিরক্তি
  • নবজাতকের ক্ষেত্রে মাথার ফন্টানেল (মাথার নরম অংশ) ভেতরে ঢুকে যাওয়া
  • শরীরের ওজন হঠাৎ কমে যাওয়া

বাচ্চার পানিশূন্যতা হলে করণীয়-

বাচ্চার পানিশূন্যতা হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

  • ওআরএস (ORS) খাওয়ানো
    শিশুদের পানিশূন্যতা প্রতিরোধে ওআরএস সবচেয়ে কার্যকর। ডায়রিয়া বা বমি হলে শিশুকে নিয়মিত অল্প অল্প করে ওআরএস খাওয়াতে হবে।
  • মায়ের দুধ খাওয়ানো
    নবজাতকের ক্ষেত্রে মায়ের দুধই সেরা প্রতিকার। অসুস্থ থাকলেও শিশুকে নিয়মিত মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পানি দেওয়া (বয়স উপযোগী হলে)
    বড় বাচ্চাদের পানি পান করতে উৎসাহিত করুন।
  • পুষ্টিকর তরল খাবার
    স্যুপ, ভাতের মাড়, ফলের রস ইত্যাদি শিশুর শরীরে পানির ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে।
  • ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া
    গুরুতর পানিশূন্যতা হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অনেক সময় স্যালাইন দিতে হতে পারে।

বাচ্চার পানিশূন্যতার জটিলতা-

পানিশূন্যতা হলে শিশুর শরীরে একাধিক জটিলতা তৈরি হতে পারে:

  • খিঁচুনি
  • রক্তচাপ কমে যাওয়া
  • কিডনি বিকল
  • মস্তিষ্কে ক্ষতি
  • গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে

বাচ্চার পানিশূন্যতা প্রতিরোধে করণীয়-

  • শিশুকে সবসময় পর্যাপ্ত পানি পান করান।
  • গরমে খেলাধুলার পর শিশুকে পানি ও তরল খাবার দিন।
  • ডায়রিয়া বা বমি হলে সাথে সাথে ওআরএস দিন।
  • নবজাতককে নিয়মিত মায়ের দুধ খাওয়ান।
  • শিশুর খাবার পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখুন।
  • শিশুর অসুস্থতা হলে অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

বাচ্চার পানিশূন্যতা নিয়ে ভুল ধারণা-

  • অনেকেই মনে করেন শুধু ডায়রিয়ায় পানিশূন্যতা হয়। আসলে বমি, জ্বর ও ঘাম থেকেও হতে পারে।
  • কেউ কেউ শিশুকে ডায়রিয়া হলে খাবার বন্ধ করে দেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়, বরং তরল খাবার আরও বেশি দিতে হবে।
  • অনেক অভিভাবক ওআরএস খাওয়ানো নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। কিন্তু ওআরএসই পানিশূন্যতা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ উপায়।

উপসংহার-

বাচ্চার পানিশূন্যতা একটি সাধারণ হলেও গুরুতর সমস্যা, যা সময়মতো প্রতিকার না করলে জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। অভিভাবকের দায়িত্ব হলো শিশুর পানি ও খাবারের প্রতি সচেতন থাকা, ডায়রিয়া বা বমি হলে দ্রুত ওআরএস খাওয়ানো এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া। সঠিক যত্ন, স্বাস্থ্যকর খাবার ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সহজেই বাচ্চার পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করা যায় এবং শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

 বাচ্চার পানিশূন্যতা নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১: বাচ্চার পানিশূন্যতার প্রধান কারণ কী?
উত্তর: ডায়রিয়া হলো বাচ্চার পানিশূন্যতার প্রধান কারণ। তবে বমি, জ্বর ও অতিরিক্ত ঘাম থেকেও হতে পারে।

প্রশ্ন ২: পানিশূন্যতা হলে শিশুকে কী খাওয়ানো উচিত?
উত্তর: ওআরএস, মায়ের দুধ, ভাতের মাড়, স্যুপ বা ফলের রস খাওয়ানো উচিত।

প্রশ্ন ৩: পানিশূন্যতার প্রাথমিক লক্ষণ কীভাবে বোঝা যায়?
উত্তর: শিশুর মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কম হওয়া, চোখ ঢেবে যাওয়া এবং অবসন্ন হয়ে পড়া প্রাথমিক লক্ষণ।

প্রশ্ন ৪: নবজাতকের পানিশূন্যতা হলে কী করবেন?
উত্তর: নবজাতককে বারবার মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তবে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।

প্রশ্ন ৫: বাচ্চার পানিশূন্যতা প্রতিরোধের সহজ উপায় কী?
উত্তর: পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খাওয়ানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top