নবজাতকের জন্ডিস: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও করণীয়

নবজাতকের জন্ডিস-

নবজাতকের জন্মের পর প্রথম সাত দিনের মধ্যে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা হলো নবজাতকের জন্ডিস। অনেক সময় অভিভাবকরা এটি দেখে ভয় পেয়ে যান। তবে সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে এটি কোনো জটিলতা তৈরি করে না।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব নবজাতকের জন্ডিসের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও করণীয় নিয়ে।

নবজাতকের জন্ডিস কী?-

জন্ডিস হলো এক ধরনের শারীরিক অবস্থা যেখানে শিশুর শরীরে বিলিরুবিন নামক পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ত্বক, চোখের সাদা অংশ এবং মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়।

নবজাতকের জন্ডিস হওয়ার কারণ-

নবজাতকের জন্ডিস হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:

  • শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়া – জন্মের পর শিশুর লিভার পুরোপুরি কার্যকর হয় না। ফলে অতিরিক্ত বিলিরুবিন জমে যায়।
  • মায়ের দুধের জন্ডিস – কিছু ক্ষেত্রে মায়ের দুধ খাওয়ার কারণে বিলিরুবিন বেড়ে যেতে পারে।
  • অপরিণত শিশুর জন্ম (Premature Baby) – প্রিম্যাচিউর শিশুর লিভার আরও দুর্বল থাকে।
  • রক্তের গ্রুপের অসামঞ্জস্য (ABO incompatibility) – মায়ের ও শিশুর রক্তের গ্রুপের পার্থক্যের কারণে জন্ডিস হতে পারে।
  • সংক্রমণ বা ইনফেকশন – জন্মের সময় বা পরে ইনফেকশনের কারণে জন্ডিস দেখা দিতে পারে।

নবজাতকের জন্ডিসের লক্ষণ-

অভিভাবকদের সতর্ক হওয়ার জন্য কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ হলো:

  • শিশুর ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া
  • অলসতা ও ঘুম বেশি হওয়া।
  • স্তনপান কমে যাওয়া বা খেতে অনীহা।
  • ওজন না বাড়া বা দ্রুত কমে যাওয়া।
  • গুরুতর হলে অতিরিক্ত কান্না বা খিঁচুনি হতে পারে।

নবজাতকের জন্ডিস কতদিন থাকে?

সাধারণত জন্মের ২-৩ দিন পর জন্ডিস দেখা দেয় এবং ৭-১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে প্রিম্যাচিউর শিশুর ক্ষেত্রে এটি ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।

নবজাতকের জন্ডিসের চিকিৎসা-

নবজাতকের জন্ডিস চিকিৎসা নির্ভর করে শিশুর অবস্থার ওপর। সাধারণত:

  • ফোটোথেরাপি (Phototherapy) – বিশেষ নীল আলো ব্যবহার করে বিলিরুবিন ভেঙে দেওয়া হয়।
  • মায়ের দুধ খাওয়ানো – শিশুকে ঘন ঘন স্তন্যপান করানো উচিত, যাতে বিলিরুবিন মলের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।
  • রক্ত পরিবর্তন (Exchange transfusion) – গুরুতর ক্ষেত্রে শিশুর রক্ত পরিবর্তন করা হয়।
  • ওষুধ – খুব কম ক্ষেত্রেই ডাক্তার কিছু ওষুধ দিতে পারেন।

নবজাতকের জন্ডিস প্রতিরোধে করণীয়-

যদিও নবজাতকের জন্ডিস সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু সাবধানতা এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে এর মাত্রা কমানো এবং জন্ডিসের জটিলতা প্রতিরোধ করা যায়।

১. নিয়মিত স্তন্যপান

  • নবজাতককে জন্মের পর থেকেই ঘন ঘন মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত।

  • প্রতিদিন অন্তত ৮–১২ বার স্তন্যপান করানো শিশুর শরীর থেকে বিলিরুবিন দ্রুত বের হতে সাহায্য করে।

  • প্রিম্যাচিউর বা কম ওজনের শিশুর ক্ষেত্রে ঘনপান আরও গুরুত্বপূর্ণ।

২. শিশুর মল ও প্রস্রাব পর্যবেক্ষণ

  • শিশুর মলত্যাগ নিয়মিত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল করা।

  • মল কম হলে শিশুর বিলিরুবিন শরীর থেকে ঠিকমতো বের হচ্ছে না, যা জন্ডিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

  • প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর হাইড্রেশন বা পুষ্টি বাড়ানো।

৩. সঠিক আলো ব্যবস্থা

  • নবজাতককে সূর্যালোকের কাছে সংক্ষিপ্ত সময় রাখতে পারলে স্বাভাবিকভাবে বিলিরুবিন কমতে সাহায্য করে।

  • তবে অতিরিক্ত সরাসরি রোদ শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

  • গুরুতর জন্ডিসের ক্ষেত্রে ডাক্তার ফোটোথেরাপি ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।

৪. শিশুর রক্ত ও লিভার পরীক্ষা

  • জন্মের আগে বা পরবর্তী প্রথম সপ্তাহে শিশুর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা যেতে পারে।

  • মায়ের ও শিশুর রক্ত গ্রুপের অসামঞ্জস্য থাকলে দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।

৫. প্রিম্যাচিউর ও কম ওজনের শিশুদের বিশেষ যত্ন

  • প্রিম্যাচিউর শিশুর লিভার এখনও পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয় না।

  • অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে ঘন ঘন স্তন্যপান ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ।

৬. ডাক্তারের নিয়মিত পরামর্শ

  • জন্মের প্রথম সপ্তাহে শিশুর চিকিৎসক দ্বারা ত্বক ও চোখের রঙ পরীক্ষা করা জরুরি।

  • যদি হলুদ রঙ দ্রুত বাড়ে বা অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়, তাৎক্ষণিক চিকিৎসা।

৭. মাতৃসন্তান স্বাস্থ্য সচেতনতা

  • মা পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং সুষম খাবার খান।

  • মা সুস্থ থাকলে শিশুর দুধের গুণগত মান বজায় থাকে, যা জন্ডিস কমাতে সাহায্য করে।

কখন ডাক্তার দেখাবেন?-

অভিভাবকরা নিচের লক্ষণগুলো দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যাবেন:

  • শিশুর ত্বক ও চোখ অত্যধিক হলুদ হয়ে যাওয়া।
  • জন্ডিস ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকা।
  • শিশুর স্তন্যপান কমে যাওয়া বা খেতে না চাওয়া।
  • অতিরিক্ত ঘুমানো বা খিঁচুনি হওয়া।

উপসংহার-

নবজাতকের জন্ডিস একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক সমস্যা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়। অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে নবজাতকের জন্ডিস কোনো স্থায়ী ক্ষতি করে না।

প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: নবজাতকের জন্ডিস কি বিপজ্জনক?
উত্তর: সাধারণত নবজাতকের জন্ডিস বিপজ্জনক নয়। তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি লিভার বা মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে।

প্রশ্ন ২: নবজাতকের জন্ডিস হলে কি ওষুধ খাওয়ানো দরকার?
উত্তর: সাধারণত ওষুধের প্রয়োজন হয় না। ঘন ঘন মায়ের দুধ খাওয়ানো ও ফোটোথেরাপি যথেষ্ট।

প্রশ্ন ৩: মায়ের দুধ কি জন্ডিসের কারণ হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে মায়ের দুধের কারণে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। তবে চিকিৎসক সাধারণত মায়ের দুধ বন্ধ না করে চালিয়ে যেতে বলেন।

প্রশ্ন ৪: নবজাতকের জন্ডিস কি সবার হয়?
উত্তর: প্রায় ৬০% পূর্ণমেয়াদি এবং ৮০% অপরিণত শিশুর জন্ডিস হয়। এটি খুবই সাধারণ একটি বিষয়।

প্রশ্ন ৫: নবজাতকের জন্ডিসের দ্রুত সমাধান কী?
উত্তর: শিশুকে পর্যাপ্ত স্তন্যপান করানো এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ফোটোথেরাপি দেওয়া।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top