গরমে শিশুর যত্ন-
বাংলাদেশের মতো উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে ঘামের গ্রন্থি পুরোপুরি বিকশিত হয় না, ফলে তারা সহজে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ কারণে গরমে শিশুর শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে যায়, ঘামাচি, জ্বর, ডায়রিয়া, ইনফেকশনসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। তাই প্রতিটি মা-বাবারই জরুরি দায়িত্ব হলো গরমে শিশুর যত্ন সঠিকভাবে নেওয়া।
এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব—গরমে শিশুর যত্ন, কীভাবে তাদের আরামদায়ক রাখা যায়, কোন খাবার দেওয়া উচিত, কোন পোশাক মানানসই এবং কোন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
গরমে শিশুর সমস্যা কেন বেশি হয়?-
১. শিশুদের শরীরে পানি দ্রুত বের হয়ে যায়।
২. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো শক্তিশালী নয়।
৩. গরমে সংক্রমণ ও ডায়রিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৪. শিশুরা সহজেই রোদে ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৫. মশা-বাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিও থাকে।
গরমে শিশুর যত্নে অভিভাবকের করণীয়-
১. শিশুর পোশাক:
- হালকা, ঢিলেঢালা ও সুতির কাপড় পরানো উচিত।
- গাঢ় রঙের পোশাক এড়িয়ে চলা ভালো।
- রাতে ঘুমের সময় পাতলা চাদর ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. ঘরের পরিবেশ:
- ঘরকে শীতল ও বাতাস চলাচলযোগ্য রাখা উচিত।
- ফ্যান বা এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে সরাসরি শিশুর উপর না।
- শিশুকে কখনোই গরম ও বাতাসহীন ঘরে রাখা উচিত নয়।
৩. শিশুর খাবার:
- ৬ মাস বয়স পর্যন্ত কেবল বুকের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট।
- ৬ মাসের পর শিশুকে সহজপাচ্য ও তরল খাবার যেমন ফলের রস, ডাবের পানি, স্যুপ দেওয়া যেতে পারে।
- শিশুকে পর্যাপ্ত পানি খাওয়ানো জরুরি (৬ মাসের বেশি হলে)।
৪. শিশুর ঘুম:
- গরমে শিশুর ঘুম ভাঙা স্বাভাবিক।
- শিশুর ঘরে ফ্যান চালিয়ে হালকা বাতাস দেওয়া উচিত।
- বিছানার চাদর পরিষ্কার ও হালকা রাখতে হবে।
৫. শিশুর ত্বকের যত্ন:
- ঘামাচি এড়াতে প্রতিদিন গোসল করানো জরুরি।
- শিশুর ত্বক শুষ্ক হলে হালকা বেবি লোশন ব্যবহার করা যায়।
- গরমে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার না করাই ভালো।
গরমে শিশুর অসুখ প্রতিরোধ-
গরমে শিশুরা যেসব অসুখে বেশি ভোগে—
- ঘামাচি
- ডায়রিয়া
- জ্বর
- সর্দি-কাশি
- ডিহাইড্রেশন
প্রতিরোধের উপায়:
- শিশুকে নিয়মিত গোসল করান।
- সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখুন।
- শিশুর খেলনা ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখুন।
- শিশুকে মশার কামড় থেকে বাঁচাতে নেট ব্যবহার করুন।
গরমে নবজাতকের যত্ন-
- নবজাতককে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই, তবে ভিজে কাপড়ে মুছে দেওয়া যেতে পারে।
- কেবল বুকের দুধ খাওয়ানোই যথেষ্ট।
- নবজাতককে সরাসরি রোদে নেওয়া ঠিক নয়।
- মায়ের শরীর থেকেও শিশুর আরাম পাওয়া যায়, তাই বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুকে কাছে রাখুন।
গরমে শিশুর ওজন ও বৃদ্ধি-
গরমকালে শিশুর ক্ষুধা কিছুটা কমে যেতে পারে। এতে অনেক অভিভাবক চিন্তিত হন। তবে সঠিক যত্ন নিলে শিশুর ওজন স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
- পর্যাপ্ত বুকের দুধ খাওয়ানো অব্যাহত রাখতে হবে।
- ৬ মাসের বেশি হলে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
- শিশুকে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
গরমে ভ্রমণে শিশুর যত্ন-
- শিশুকে রোদে দীর্ঘ সময় বাইরে রাখা উচিত নয়।
- বাইরে গেলে টুপি বা হালকা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে দিন।
- শিশুর জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পানি ও খাবার সঙ্গে রাখুন।
- মশা ও ধুলো থেকে সুরক্ষা দিতে হালকা কাপড় ব্যবহার করুন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?-
- শিশুর শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে।
- শিশুর প্রস্রাব কমে গেলে বা প্রস্রাব গাঢ় রঙের হলে।
- ডায়রিয়া বা বমি হলে।
- শিশুর শরীরে ঘামাচি থেকে ইনফেকশন হলে।
- শিশুর শরীর দুর্বল বা অবসন্ন দেখালে।
উপসংহার-
গরমে শিশুর যত্ন নেওয়া মানে শুধু তাদের আরাম দেওয়া নয়, বরং তাদের স্বাস্থ্য, সঠিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিশ্চিত করা। অভিভাবকদের উচিত গরমকালে শিশুর খাবার, ঘুম, ত্বক ও পরিবেশ সবকিছুতে বাড়তি নজর দেওয়া। সঠিক যত্ন নিলে শিশুরা গরমেও সুস্থ ও স্বস্তিতে থাকতে পারে।
গরমে শিশুর যত্ন নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: গরমে শিশুকে দিনে কয়বার গোসল করানো উচিত?
উত্তর: দিনে একবার গোসল যথেষ্ট। তবে শিশুর শরীর বেশি ঘামলে ভিজে কাপড়ে মুছে দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ২: গরমে কি শিশুকে রাতে এয়ার কন্ডিশন রুমে রাখা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, রাখা যাবে। তবে তাপমাত্রা ২৬–২৮ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হবে এবং সরাসরি শিশুর শরীরে এয়ার না লাগানো উচিত।
প্রশ্ন ৩: গরমে নবজাতককে পানি খাওয়ানো উচিত কি না?
উত্তর: না, ৬ মাস বয়সের আগে কোনো পানি খাওয়ানো যাবে না। শুধু বুকের দুধই যথেষ্ট।
প্রশ্ন ৪: গরমে শিশুর খাবারে কী দেওয়া উচিত?
উত্তর: ৬ মাসের বেশি বয়সী শিশুকে ফলের রস, ডাবের পানি, ভাতের মাড়, স্যুপ এবং সহজপাচ্য খাবার দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ৫: গরমে শিশুর ঘামাচি কমানোর উপায় কী?
উত্তর: প্রতিদিন গোসল করানো, হালকা পোশাক পরানো এবং শিশুকে ঠান্ডা ও বাতাস চলাচলযোগ্য পরিবেশে রাখা ঘামাচি প্রতিরোধ করে।