শীতকালে শিশুর যত্ন: করণীয় ও সতর্কতা-
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক জায়গায় শীতকাল খুব কঠিন না হলেও, ছোট শিশুদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জের সময়। কারণ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে এবং আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তনেই তারা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে শীতে শিশুর ত্বকের শুষ্কতা, সর্দি-কাশি, কফ, নিউমোনিয়া, জ্বর ইত্যাদি সমস্যা খুব সাধারণ। তাই সচেতন অভিভাবকদের সবসময় জানতে হবে— শীতকালে শিশুর যত্ন নেওয়ার সঠিক উপায়।
শীতকালে শিশুর সাধারণ সমস্যা-
শীতকালে শিশুরা যেসব সমস্যায় বেশি ভোগে, সেগুলো হলো:
- সর্দি-কাশি ও কফ জমা – ঠান্ডা লাগলে সহজেই শ্বাসকষ্ট হয়।
- ত্বকের শুষ্কতা – শীতে বাতাস শুকনো থাকে, ফলে শিশুর কোমল ত্বক ফেটে যেতে পারে।
- নিউমোনিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ – শীতকালে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- ক্ষুধামন্দা – ঠান্ডায় অনেক শিশুই খাবারে অনীহা প্রকাশ করে।
- অ্যালার্জি ও অ্যাজমা সমস্যা – শীতকালে ধুলোবালির কারণে অনেক শিশুর অ্যাজমা বেড়ে যায়।
শীতকালে শিশুর যত্নে করণীয়-
শিশুকে সুস্থ রাখতে শীতে কিছু বাড়তি যত্ন নেওয়া জরুরি।
১. শিশুর পোশাক নির্বাচন
শীতে শিশুকে অতিরিক্ত কাপড়ে জড়ানো উচিত নয়। কারণ এতে শিশুর শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে যেতে পারে।
- শিশুর জন্য তুলা বা উলের নরম পোশাক বেছে নিন।
- রাতে শিশুকে স্যোয়েটার, মোজা ও টুপি পরিয়ে দিন।
- বারবার ভারী পোশাক পরাবেন না; হালকা ও আরামদায়ক কাপড় ভালো।
২. শিশুর ঘর ও পরিবেশ
শিশুর ঘর সবসময় পরিষ্কার ও উষ্ণ রাখতে হবে।
- জানালা-দরজা বন্ধ রেখে ঘরে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন।
- শিশুর বিছানায় নরম কম্বল ব্যবহার করুন।
- ধুলোবালি যেন ঘরে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
৩. শীতে শিশুর খাবার
শীতকালে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খাবারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
- মায়ের দুধ হলো নবজাতক ও ছোট শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাবার।
- ৬ মাসের বেশি বয়সী শিশুদের শাকসবজি, ফল, ডাল, ডিম ইত্যাদি খাওয়ান।
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন কমলা, পেয়ারা ইমিউনিটি বাড়ায়।
- গরম দুধ, স্যুপ শিশুর শরীর গরম রাখতে সাহায্য করে।
৪. শিশুর ত্বকের যত্ন
শীতে শিশুর ত্বক ফেটে যাওয়া বা র্যাশ হওয়া স্বাভাবিক।
- প্রতিদিন শিশুর শরীরে বেবি অয়েল বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
- গরম পানিতে বারবার গোসল করানো ঠিক নয়; হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন।
- শিশুর ঠোঁট শুকিয়ে গেলে ভ্যাসেলিন ব্যবহার করতে পারেন।
৫. শিশুকে ঠান্ডা ও সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা
- শিশুকে বাইরে নিয়ে গেলে কানে ও মাথায় টুপি দিন।
- ঠান্ডা বাতাস সরাসরি শিশুর গায়ে লাগতে দেবেন না।
- হাঁচি-কাশি আছে এমন মানুষের কাছ থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।
- প্রয়োজনে ডাক্তারি পরামর্শে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দিন।
৬. ঘরোয়া উপায়
অনেক সময় প্রাথমিক যত্নে ঘরোয়া উপায়ও কাজে লাগে।
- সর্দি হলে শিশুর মাথার কাছে গরম পানির বাষ্প রাখতে পারেন।
- শিশুর নাকে হালকা স্যালাইন ড্রপ দিলে শ্বাসকষ্ট কমে।
- মধু এক বছরের বেশি বয়সী শিশুর কাশি কমাতে সাহায্য করে।
শীতকালে নবজাতকের যত্ন-
নবজাতক সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল। তাই তাদের জন্য বিশেষ সতর্কতা দরকার।
- নবজাতককে সবসময় শুকনো ও পরিষ্কার কাপড়ে রাখুন।
- মায়ের বুকের দুধ বারবার খাওয়ান, এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- শিশুর শরীর গরম রাখতে মায়ের কোলে বেশি রাখুন (ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার)।
- নবজাতকের জন্য ঘর উষ্ণ রাখা অত্যন্ত জরুরি।
শীতকালে শিশুর জন্য করণীয় ও বর্জনীয়-
করণীয়:
- শিশুকে সবসময় উষ্ণ পরিবেশে রাখা।
- ত্বকের যত্নে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা।
- মায়ের দুধ ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো।
- শিশুর পোশাক বারবার বদলানো।
বর্জনীয়:
- শিশুকে অতিরিক্ত মোটা কাপড়ে জড়িয়ে রাখা।
- খুব গরম পানি দিয়ে গোসল করানো।
- অসুস্থ অবস্থায় ওষুধ খাওয়ানো (ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া)।
- শিশুকে বাইরে দীর্ঘ সময় রাখা।
শীতকালে শিশুর যত্নে অভিভাবকদের সাধারণ ভুল-
- মনে করা যে যত বেশি কাপড় পরানো হবে, শিশু তত নিরাপদ থাকবে।
- গোসল না করিয়ে শিশুকে উষ্ণ রাখা।
- ঠান্ডা লাগলে ওষুধ না খাইয়ে অবহেলা করা।
- শিশুর ত্বকের যত্ন না নেওয়া।
উপসংহার-
শীতকালে শিশুর যত্ন নেওয়া অভিভাবকদের অন্যতম বড় দায়িত্ব। সচেতনতা ও সঠিক যত্নের মাধ্যমে শিশুকে ঠান্ডা, সর্দি, কাশি ও ত্বকের সমস্যা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। তাই শীতকালে শিশুর যত্ন বিষয়ে নিয়মিত খেয়াল রাখুন এবং কোনো জটিল সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারি পরামর্শ নিন।
শীতকালে শিশুর যত্ন নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন-
প্রশ্ন ১: শীতে কতদিন পর শিশুকে গোসল করানো উচিত?
উত্তর: প্রতিদিন নয়, ২-৩ দিন পর কুসুম গরম পানি দিয়ে শিশুকে গোসল করানো যথেষ্ট।
প্রশ্ন ২: শীতে নবজাতককে কি বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়?
উত্তর: খুব বেশি ঠান্ডা বা ধোঁয়াশা থাকলে নবজাতককে বাইরে নেওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন ৩: শিশুর শীতে সবচেয়ে বেশি কী সমস্যা হয়?
উত্তর: সর্দি, কাশি, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া ও জ্বর।
প্রশ্ন ৪: শীতে শিশুর ত্বক ফাটলে কী করব?
উত্তর: শিশুর জন্য উপযোগী ময়েশ্চারাইজার বা বেবি অয়েল ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে ডাক্তার দেখান।
প্রশ্ন ৫: শীতে শিশুর ডায়েট কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর: মায়ের দুধ, গরম খাবার, ফল, শাকসবজি, দুধ-ডিম এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার।