নবজাতক শিশুর খিঁচুনি-
নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর ও জটিল একটি অবস্থা হলো নবজাতক শিশুর খিঁচুনি। জীবনের প্রথম ২৮ দিনের মধ্যে কোনো শিশুর অস্বাভাবিক মস্তিষ্কীয় কার্যক্রমের কারণে হঠাৎ শরীর কেঁপে ওঠা, হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক নড়াচড়া খিঁচুনির লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। অনেক সময় খিঁচুনিকে সাধারণ কাঁপুনি ভেবে অভিভাবকরা গুরুত্ব দেন না, অথচ সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো নবজাতক শিশুর খিঁচুনি সম্পর্কিত কারণ, লক্ষণ, ধরন, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে।
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি কী?-
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি হলো এক ধরনের স্নায়বিক অস্বাভাবিকতা, যেখানে শিশুর মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ঘটে। এর ফলে শরীরে অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া, হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া, চোখ উপরের দিকে চলে যাওয়া কিংবা হঠাৎ ঝাঁকি দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা পরিভাষায় এটি “Neonatal Seizures” নামে পরিচিত। সাধারণত এটি শিশুর জন্মের পর প্রথম সপ্তাহে বেশি দেখা যায়।
নবজাতক শিশুর খিঁচুনির কারণ-
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
- অক্সিজেনের অভাব (Birth Asphyxia):
জন্মের সময় শিশুর মস্তিষ্কে যথেষ্ট অক্সিজেন না পৌঁছালে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। - মস্তিষ্কে আঘাত বা রক্তক্ষরণ:
প্রসবের সময় আঘাত, প্রসব জটিলতা বা মাথায় রক্তক্ষরণ শিশুর খিঁচুনির অন্যতম কারণ। - ইনফেকশন বা সংক্রমণ:
মেনিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস বা শরীরের অন্যান্য সংক্রমণ নবজাতক খিঁচুনির ঝুঁকি বাড়ায়। - রক্তে শর্করা কমে যাওয়া (Hypoglycemia):
অনেক সময় শিশুর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে খিঁচুনি হতে পারে। - ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা:
সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি বা অসামঞ্জস্য খিঁচুনি ঘটাতে পারে। - জেনেটিক বা বংশগত কারণ:
পরিবারের কারো খিঁচুনি রোগ থাকলে শিশুর মধ্যেও এটি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। - অকাল জন্ম:
অপরিণত বা প্রিম্যাচিউর শিশুদের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্র পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত না হওয়ায় খিঁচুনির ঝুঁকি বেশি।
নবজাতক শিশুর খিঁচুনির লক্ষণ-
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি অনেক সময় স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- হঠাৎ করে হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া
- শরীর কেঁপে ওঠা বা ঝাঁকি দেওয়া
- চোখ উপরের দিকে চলে যাওয়া বা একদিকে ঘুরে যাওয়া
- মুখে হঠাৎ টান পড়া বা ঠোঁট নড়াচড়া করা
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া
- শরীর হঠাৎ ঢিলে হয়ে যাওয়া
- শিশুর কান্না অস্বাভাবিকভাবে থেমে যাওয়া
অভিভাবকদের মনে রাখা উচিত, নবজাতকের সাধারণ কাঁপুনি (জ্বর বা ঠান্ডার কারণে) আর খিঁচুনি আলাদা বিষয়। তাই সন্দেহ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
নবজাতক শিশুর খিঁচুনির ধরন-
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি প্রধানত কয়েক ধরনের হতে পারে:
- ক্লোনিক খিঁচুনি (Clonic Seizures): হাত-পা বা শরীরের এক অংশ বারবার ঝাঁকির মতো কেঁপে ওঠে।
- টনিক খিঁচুনি (Tonic Seizures): শিশুর শরীর শক্ত হয়ে যায় এবং অচল থাকে।
- মায়োক্লোনিক খিঁচুনি (Myoclonic Seizures): হঠাৎ শরীর বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঝাঁকি খায়।
- সাবটাইল খিঁচুনি (Subtle Seizures): সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যেখানে চোখ কুঁচকে যাওয়া, ঠোঁট নড়াচড়া, শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
নবজাতক শিশুর খিঁচুনির ঝুঁকি-
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি সময়মতো চিকিৎসা না করলে মারাত্মক জটিলতা তৈরি করতে পারে। যেমন:
- মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি
- মানসিক বিকাশে সমস্যা
- পরবর্তীতে মৃগী রোগ হওয়ার ঝুঁকি
- শারীরিক প্রতিবন্ধকতা
- মৃত্যুঝুঁকি
নবজাতক শিশুর খিঁচুনির চিকিৎসা-
খিঁচুনির চিকিৎসা নির্ভর করে এর মূল কারণের ওপর।
- প্রাথমিক সাপোর্টিভ কেয়ার:
- শিশুকে নিরাপদ জায়গায় রাখা
- শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখা
- অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা
- ঔষধ প্রয়োগ:
চিকিৎসক সাধারণত ফেনোবারবিটাল, ফেনিটয়েন, লেভেটিরাসেটাম ইত্যাদি অ্যান্টি-সিজার ওষুধ ব্যবহার করেন। - ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ:
সংক্রমণ থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। - শর্করা বা ইলেক্ট্রোলাইট ঠিক করা:
গ্লুকোজ, ক্যালসিয়াম বা সোডিয়ামের অভাব থাকলে তা পূরণ করা হয়। - বিশেষায়িত যত্ন:
নবজাতক আইসিইউতে (NICU) শিশুকে ভর্তি করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
নবজাতক শিশুর খিঁচুনির প্রতিকার ও প্রতিরোধ-
যদিও সবসময় খিঁচুনি প্রতিরোধ সম্ভব নয়, তবুও কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে ঝুঁকি অনেক কমানো যায়।
- গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
- প্রসব অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করা
- গর্ভকালীন সংক্রমণ প্রতিরোধ করা
- জন্মের পরপরই শিশুকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরীক্ষা করানো
- শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যাকে অবহেলা না করা
অভিভাবকদের করণীয়-
যদি শিশুর খিঁচুনি হয়, তবে আতঙ্কিত না হয়ে—
- শিশুকে সোজা জায়গায় শুইয়ে দিন
- মাথা পাশে করে দিন যেন শ্বাস বন্ধ না হয়
- মুখে কোনো কিছু ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না
- খিঁচুনির সময় ও প্রকৃতি লক্ষ্য করুন
- দ্রুত শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যান
নবজাতক শিশুর খিঁচুনি: মিথ ও ভুল ধারণা-
- অনেক অভিভাবক মনে করেন শিশুর কাঁপুনি মানেই খিঁচুনি – এটি সবসময় সত্য নয়।
- কেউ কেউ ঝাড়ফুঁক বা ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে খিঁচুনি সারাতে চান, যা বিপজ্জনক।
- সময়মতো চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ শিশু সুস্থ হতে পারে।
প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: নবজাতক শিশুর খিঁচুনি কতটা গুরুতর?
উত্তর: নবজাতক শিশুর খিঁচুনি গুরুতর একটি অবস্থা। সঠিক চিকিৎসা না পেলে মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি বা প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
প্রশ্ন ২: নবজাতকের সাধারণ কাঁপুনি আর খিঁচুনির মধ্যে পার্থক্য কীভাবে বোঝা যায়?
উত্তর: সাধারণ কাঁপুনি থামানো যায়, কিন্তু খিঁচুনি থামানো যায় না। এছাড়া খিঁচুনির সময় চোখ উপরে উঠে যায়, শ্বাস বন্ধ হতে পারে, শরীর শক্ত হয়ে যায়।
প্রশ্ন ৩: নবজাতক শিশুর খিঁচুনি হলে কি সারাজীবন মৃগী হবে?
উত্তর: সবসময় নয়। তবে যদি মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হয়, তাহলে ভবিষ্যতে মৃগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন ৪: নবজাতক খিঁচুনির চিকিৎসা কোথায় করা উচিত?
উত্তর: শিশু বিশেষজ্ঞ বা নবজাতক বিশেষায়িত হাসপাতাল/ NICU তে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ৫: নবজাতক শিশুর খিঁচুনি প্রতিরোধ করা সম্ভব কি?
উত্তর: সব ক্ষেত্রে নয়। তবে গর্ভকালীন সঠিক যত্ন, নিরাপদ প্রসব, ও শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রতিরোধে সহায়ক।