গর্ভকালীন খিচুঁনি: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

গর্ভকালীন খিচুঁনি-

গর্ভকালীন সময় একজন নারীর শরীরে নানা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। এই সময় মায়ের সুস্থতা কেবল তাঁর নিজের জন্যই নয়, গর্ভের সন্তানের সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত জরুরি। গর্ভাবস্থার অন্যতম গুরুতর সমস্যা হলো গর্ভকালীন খিচুঁনি বা Eclampsia। এটি এমন একটি জটিল অবস্থা, যা সময়মতো চিকিৎসা না করলে মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই জীবন-হানিকর হতে পারে।

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গর্ভকালীন খিচুঁনি একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো এক্লাম্পসিয়া। তাই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব গর্ভকালীন খিচুঁনির কারণ, লক্ষণ, ঝুঁকি, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে।

গর্ভকালীন খিচুঁনি কী?-

গর্ভকালীন খিচুঁনি হলো একটি স্নায়বিক জটিলতা, যা সাধারণত প্রি-এক্লাম্পসিয়া নামক অবস্থার ফলস্বরূপ ঘটে। প্রি-এক্লাম্পসিয়া হলো গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, শরীরে অতিরিক্ত ফোলা এবং প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গমনের একটি অবস্থা। যখন প্রি-এক্লাম্পসিয়া অবহেলায় চিকিৎসাহীন থাকে, তখন তা খিঁচুনি বা এক্লাম্পসিয়ায় রূপ নিতে পারে।

সাধারণভাবে বলা যায়—

  • প্রি-এক্লাম্পসিয়া = উচ্চ রক্তচাপ + প্রোটিন ইউরিয়া + শরীরে ফোলা
  • এক্লাম্পসিয়া (গর্ভকালীন খিচুঁনি) = প্রি-এক্লাম্পসিয়ার সাথে খিঁচুনি

গর্ভকালীন খিচুঁনির কারণ-

গর্ভকালীন খিচুঁনির সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে কিছু শারীরবৃত্তীয় ও পরিবেশগত কারণে এর ঝুঁকি বাড়ে।

প্রধান কারণগুলো হলো:

  • উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension):
    গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ প্রি-এক্লাম্পসিয়া এবং পরে এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।
  • প্লাসেন্টার অস্বাভাবিকতা:
    ভ্রূণের সাথে মাতৃ শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হলে খিঁচুনি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • জেনেটিক কারণ:
    পরিবারে কারও এক্লাম্পসিয়ার ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • কিডনি ও লিভারের সমস্যা:
    গর্ভাবস্থায় কিডনি বা লিভারের অসুস্থতা থাকলে খিঁচুনির সম্ভাবনা বেশি।
  • প্রথম গর্ভধারণ:
    প্রথমবার মা হতে যাওয়া নারীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
  • অল্প বয়স বা বয়স্ক গর্ভবতী মা:
    ১৮ বছরের নিচে বা ৩৫ বছরের বেশি বয়সী মায়েদের ঝুঁকি বেশি।
  • ডায়াবেটিস ও স্থূলতা:
    ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বা অতিরিক্ত ওজনের নারীরা উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।

গর্ভকালীন খিচুঁনির লক্ষণ-

গর্ভকালীন খিচুঁনি হঠাৎ করেই শুরু হতে পারে। তবে সাধারণত কিছু সতর্ক সংকেত আগে থেকেই লক্ষ্য করা যায়।

সতর্ক সংকেত ও লক্ষণ:

  • প্রচণ্ড মাথাব্যথা
  • চোখে ঝাপসা দেখা বা অন্ধকার দেখা
  • হাত-পা, মুখমণ্ডল ও চোখের চারপাশে অস্বাভাবিক ফোলা
  • উচ্চ রক্তচাপ (১৪০/৯০ mmHg এর উপরে)
  • প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গমন
  • তীব্র পেটব্যথা, বিশেষত ডান দিকের উপরের অংশে
  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও শ্বাসকষ্ট

খিঁচুনির সময় যা ঘটে:

  • পুরো শরীর কেঁপে ওঠা
  • চোখ উল্টে যাওয়া
  • জ্ঞান হারানো
  • মুখ থেকে ফেনা বের হওয়া

এই লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত।

গর্ভকালীন খিচুঁনির ঝুঁকি-

গর্ভকালীন খিচুঁনি শুধু মায়ের জন্য নয়, গর্ভের শিশুর জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।

মায়ের জন্য ঝুঁকি:

  • মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ
  • অঙ্গ বিকল (কিডনি, লিভার)
  • কোমা
  • মাতৃমৃত্যু

শিশুর জন্য ঝুঁকি:

  • অকালে জন্ম
  • কম ওজনের শিশু
  • মৃতভ্রূণ (Stillbirth)
  • নবজাতকের মৃত্যু

গর্ভকালীন খিচুঁনির নির্ণয়-

একজন গর্ভবতী মায়ের খিঁচুনি হলে চিকিৎসক সাধারণত রোগীর ইতিহাস, রক্তচাপ, প্রস্রাব পরীক্ষা এবং কিছু ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হন।

পরীক্ষার মধ্যে থাকে:

  • রক্তচাপ মাপা
  • প্রস্রাবে প্রোটিন পরীক্ষা
  • রক্তের CBC, লিভার ও কিডনি ফাংশন টেস্ট
  • আল্ট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভকালীন খিচুঁনির চিকিৎসা-

গর্ভকালীন খিচুঁনির চিকিৎসা একটি জরুরি ব্যবস্থা। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, মা ও শিশুর ঝুঁকি তত কমে।

প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি:

  • অ্যান্টি-কনভালসেন্ট ওষুধ:
    খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সবচেয়ে কার্যকর।
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ:
    হাইড্রালাজিন, ল্যাবেটালল, নিফেডিপাইন ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
  • অক্সিজেন সাপোর্ট ও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট:
    মায়ের শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক রাখতে প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন দেওয়া হয়।
  • শিশুর জন্মদান:
    অনেক ক্ষেত্রে গর্ভকালীন খিচুঁনির একমাত্র স্থায়ী সমাধান হলো শিশুর জন্মদান (Normal Delivery বা C-Section)।

গর্ভকালীন খিচুঁনির প্রতিরোধ-

গর্ভকালীন খিচুঁনি প্রতিরোধ সম্ভব হলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমানো যায়।

প্রতিরোধের উপায়:

  • নিয়মিত প্রসূতি পরীক্ষা করা
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • লবণ কম খাওয়া
  • পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • ডায়াবেটিস বা অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • অ্যালকোহল ও ধূমপান থেকে বিরত থাকা
  • ক্যালসিয়াম ও ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)

কখন ডাক্তার দেখাবেন?-

নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত:

  • তীব্র মাথাব্যথা
  • চোখে ঝাপসা দেখা
  • হাত-পায়ে অস্বাভাবিক ফোলা
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • খিঁচুনি

উপসংহার-

গর্ভকালীন খিচুঁনি একটি ভয়াবহ জটিলতা হলেও সচেতনতা ও সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। প্রতিটি গর্ভবতী মায়ের উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

মনে রাখতে হবে, গর্ভকালীন খিচুঁনি প্রতিরোধই সর্বোত্তম সমাধান।

গর্ভকালীন খিচুঁনি সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: গর্ভকালীন খিচুঁনি কি সব গর্ভবতী নারীর হতে পারে?
উত্তর: না, তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা পারিবারিক ইতিহাস আছে তাদের ঝুঁকি বেশি।

প্রশ্ন ২: গর্ভকালীন খিচুঁনি হলে কি স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব?
উত্তর: চিকিৎসক পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন। অনেক ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারি করতে হয়।

প্রশ্ন ৩: গর্ভকালীন খিচুঁনির চিকিৎসা কি সম্পূর্ণ সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, সময়মতো চিকিৎসা নিলে মাকে সুস্থ করা যায়। তবে একমাত্র স্থায়ী সমাধান হলো শিশুর জন্ম দেওয়া।

প্রশ্ন ৪: প্রি-এক্লাম্পসিয়া আর এক্লাম্পসিয়ার মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় উচ্চ রক্তচাপ, ফোলা ও প্রস্রাবে প্রোটিন থাকে, কিন্তু খিঁচুনি হয় না। এক্লাম্পসিয়ায় খিঁচুনি যুক্ত হয়।

প্রশ্ন ৫: গর্ভকালীন খিচুঁনি প্রতিরোধে কী ধরনের খাবার উপকারী?
উত্তর: কম লবণযুক্ত খাবার, শাকসবজি, ফলমূল, পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উপকারী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top