নবজাতকের চোখের সমস্যা: কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

 

নবজাতকের চোখের সমস্যা: একটি পরিচিতি-

শিশুর জন্মের পর প্রথম কয়েক মাসে চোখের যত্ন অত্যন্ত জরুরি। কারণ চোখ শুধু দৃষ্টি নয়, বরং সামগ্রিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক সময় নবজাতকের চোখে নানা সমস্যা দেখা দেয়—যেমন চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হওয়া, আলো সহ্য করতে না পারা বা চোখে পুঁজ হওয়া। এসব সমস্যা সাধারণত সামান্য হলেও কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর রোগের ইঙ্গিত দিতে পারে।

নবজাতকের চোখের সমস্যা বিষয়ে সচেতনতা থাকলে মা–বাবারা সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং শিশুর দৃষ্টি ও সুস্থতা রক্ষা করা সম্ভব হয়।

নবজাতকের চোখের সমস্যা কেন হয়?-

নবজাতকের চোখের সমস্যা নানা কারণে হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে জন্মগত সমস্যা, সংক্রমণ, পরিবেশগত কারণ ও মাতৃস্বাস্থ্যের জটিলতা।

  • জন্মগত সমস্যা (Congenital issues):
    অনেক শিশু জন্মের সময় চোখের গঠনগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। যেমন—ক্যাটারাক্ট বা গ্লুকোমা।
  • সংক্রমণ (Infections):
    জন্মের সময় মা থেকে শিশুর চোখে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এতে চোখ লাল হওয়া, পানি পড়া বা পুঁজ জমতে পারে।
  • অশ্রু নালী ব্লক (Blocked Tear Duct):
    নবজাতকের চোখ দিয়ে পানি পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অশ্রু নালী বন্ধ থাকা।
  • অ্যালার্জি বা ধূলাবালি:
    পরিবেশের ধূলা বা অ্যালার্জিজনিত কারণে চোখ চুলকানো বা লাল হতে পারে।
  • মায়ের অসুস্থতা:
    গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো সংক্রমণ (যেমন রুবেলা, টক্সোপ্লাজমা) শিশুর চোখে প্রভাব ফেলতে পারে।

নবজাতকের চোখের সমস্যা: সাধারণ লক্ষণ-

শিশুর চোখে সমস্যা হলে সাধারণত কিছু লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়। এসব লক্ষণ অবহেলা না করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

  • চোখ লাল হয়ে যাওয়া
  • চোখ দিয়ে পানি পড়া
  • চোখে পুঁজ জমা বা হলুদ রঙের স্রাব বের হওয়া
  • আলো সহ্য করতে না পারা
  • চোখ ছোট-বড় দেখা যাওয়া
  • চোখে সাদা দাগ বা কুয়াশা দেখা
  • চোখ নাড়াতে অসুবিধা হওয়া
  • ক্রমাগত চোখ মুছতে থাকা

নবজাতকের চোখের সমস্যা: সাধারণ ধরণ-

১. চোখ দিয়ে পানি পড়া (Watery Eyes):
অশ্রু নালী ব্লক থাকলে বা হালকা সংক্রমণে চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে।

২. কনজাঙ্কটিভাইটিস (Conjunctivitis):
চোখ লাল হওয়া, পুঁজ জমা ও চুলকানি—এসব হলো কনজাঙ্কটিভাইটিসের লক্ষণ। এটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অ্যালার্জির কারণে হতে পারে।

৩. জন্মগত ক্যাটারাক্ট (Congenital Cataract):
কিছু শিশু চোখে সাদা দাগ নিয়ে জন্মায়, যাকে ক্যাটারাক্ট বলে। এটি না হলে ভবিষ্যতে দৃষ্টি হারানোর ঝুঁকি থাকে।

৪. জন্মগত গ্লুকোমা (Congenital Glaucoma):
চোখ বড় হয়ে যাওয়া, আলো সহ্য করতে না পারা এবং চোখ লাল হওয়া এই সমস্যার লক্ষণ।

৫. স্ট্রাবিসমাস (Strabismus বা চোখ কাত হয়ে যাওয়া):
কিছু শিশুর চোখ ঠিকভাবে একসাথে নাড়াচাড়া করে না। একে চোখ কাত হওয়া বলা হয়।

৬. রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিম্যাচিউরিটি (ROP):
অকালজাত শিশুদের চোখে রক্তনালীর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে পারে, যা দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে।

নবজাতকের চোখের সমস্যা নির্ণয়-

চোখের সমস্যার সঠিক নির্ণয় করতে হলে শিশু বিশেষজ্ঞ ও চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।

  • শারীরিক পরীক্ষা: চোখের লালচে ভাব, পানি পড়া বা পুঁজ পরীক্ষা করা হয়।
  • আলো প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা: শিশুর চোখে আলো ফেলে প্রতিক্রিয়া দেখা হয়।
  • অপটিক নার্ভ পরীক্ষা: চোখের ভেতরের স্নায়ু স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কিনা তা দেখা হয়।
  • আল্ট্রাসাউন্ড ও ইমেজিং: জটিল সমস্যার ক্ষেত্রে করা হয়।

নবজাতকের চোখের সমস্যা চিকিৎসা-

নবজাতকের চোখের সমস্যা চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের ধরন ও জটিলতার উপর।

  • অশ্রু নালী ব্লক:
    বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১ বছরের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। শিশুর চোখ ও নাকের মাঝ বরাবর হালকা মাসাজ করতে হয়।
  • সংক্রমণ:
    ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণে চোখে এন্টিবায়োটিক আই ড্রপ বা মলম ব্যবহার করা হয়।
  • ক্যাটারাক্ট:
    জন্মগত ক্যাটারাক্ট হলে সার্জারি করে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
  • গ্লুকোমা:
    জন্মগত গ্লুকোমার ক্ষেত্রে সার্জারি বা বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
  • ROP:
    লেজার থেরাপি বা ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
  • কনজাঙ্কটিভাইটিস:
    জীবাণুনাশক ড্রপ বা অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

নবজাতকের চোখের যত্ন-

চোখের সমস্যা এড়াতে জন্মের পর থেকেই শিশুর চোখের সঠিক যত্ন নেওয়া উচিত।

  • সবসময় পরিষ্কার কাপড় দিয়ে চোখ মুছতে হবে।
  • ধূলাবালি বা ধোঁয়ার পরিবেশে শিশুকে না রাখা।
  • শিশুর চোখে নোংরা হাত না দেওয়া।
  • প্রয়োজন ছাড়া চোখে কোনো ওষুধ ব্যবহার না করা।
  • শিশুর চোখে অস্বাভাবিকতা দেখলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া।

নবজাতকের চোখের সমস্যা প্রতিরোধ-

সব চোখের সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু ক্ষেত্রে সচেতন হলে ঝুঁকি কমানো যায়।

  • গর্ভকালীন সময়ে মায়ের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
  • গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।
  • শিশুর জন্মের পর চোখ ভালোভাবে পরীক্ষা করা।
  • টিকা ঠিক সময়ে দেওয়া।
  • অকালজাত শিশুকে বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসকের কাছে দেখানো।

নবজাতকের চোখের সমস্যা: কখন ডাক্তার দেখাবেন?-

শিশুর চোখে নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে:

  • চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও পুঁজ জমা
  • চোখ দিয়ে বারবার পানি পড়া
  • চোখে সাদা দাগ বা কুয়াশা দেখা
  • আলো সহ্য করতে না পারা
  • চোখ বড় বা ছোট হয়ে যাওয়া
  • চোখ কাত হয়ে যাওয়া
  • শিশু চোখ নাড়াতে না পারা

উপসংহার-

নবজাতকের চোখের সমস্যা শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছোটখাটো সমস্যা হলেও অবহেলা করা উচিত নয়। নিয়মিত চোখ পরীক্ষা, সঠিক যত্ন এবং সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুর চোখ ও দৃষ্টি সুস্থ রাখা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, চোখের যত্ন মানে শিশুর ভবিষ্যতের যত্ন।

 নবজাতকের চোখের সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: নবজাতকের চোখ দিয়ে পানি পড়া কি স্বাভাবিক?
উত্তর: অনেক শিশুর চোখের অশ্রু নালী বন্ধ থাকার কারণে পানি পড়ে। সাধারণত ৬-১২ মাসের মধ্যে এটি সেরে যায়।

প্রশ্ন ২: নবজাতকের চোখ লাল হলে কী করতে হবে?
উত্তর: চোখ লাল হলে এটি সংক্রমণ বা অ্যালার্জির লক্ষণ হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন ৩: জন্মগত ক্যাটারাক্ট কি সারানো সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, সার্জারির মাধ্যমে ক্যাটারাক্ট অপসারণ করা যায় এবং শিশুর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

প্রশ্ন ৪: নবজাতকের চোখে আলো সহ্য না করা কি স্বাভাবিক?
উত্তর: সামান্য আলোতে বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক হতে পারে। তবে অতিরিক্ত আলো সহ্য না করলে গ্লুকোমার মতো রোগ থাকতে পারে।

প্রশ্ন ৫: নবজাতকের চোখের যত্নে কী কী খেয়াল রাখতে হবে?
উত্তর: চোখ পরিষ্কার রাখা, ধূলাবালি এড়িয়ে চলা এবং কোনো সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top