গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কী-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হলো এমন এক অবস্থা যখন মায়ের শরীরে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। হিমোগ্লোবিন কম হলে শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পরিবাহিত হয় না। এর ফলে মা ক্লান্তি দুর্বলতা ও নানা জটিলতায় ভুগতে পারেন এবং শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার কারণ-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আয়রনের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আয়রন হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া ফোলিক এসিডের অভাব ভিটামিন বি১২ এর অভাব অতিরিক্ত বমি দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাত একাধিক সন্তানের গর্ভধারণ বা অপুষ্টি থেকেও রক্তশূন্যতা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার লক্ষণ-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হলে কয়েকটি লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন সারাক্ষণ দুর্বল লাগা মাথা ঘোরা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ত্বক ও ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া হাত পা ঠান্ডা লাগা দ্রুত হৃদস্পন্দন হওয়া চুল পড়া এবং মনোযোগ ধরে রাখতে সমস্যা হওয়া।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার ঝুঁকি-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা অবহেলা করলে মা ও শিশুর উভয়ের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়। মায়ের ক্ষেত্রে প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তপাত দুর্বলতা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া দেখা দিতে পারে। শিশুর ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়া মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হওয়া অকালে জন্ম বা মৃতশিশুর ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় আয়রনের গুরুত্ব-
আয়রন হলো হিমোগ্লোবিন তৈরির মূল উপাদান। গর্ভাবস্থায় শরীরের জন্য স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ আয়রনের প্রয়োজন হয়। কারণ এ সময় মায়ের শরীরে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং শিশুর বৃদ্ধি ও প্লাসেন্টার জন্য অতিরিক্ত আয়রনের প্রয়োজন হয়।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে খাদ্যাভ্যাস-
গর্ভাবস্থায় সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন লাল মাংস মাছ কলিজা ডিম ডাল পালং শাক শাকসবজি ও শুকনো ফল খেতে হবে। পাশাপাশি ফোলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার যেমন পালং শাক ডাল কমলা কলিজা খাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন বি১২ এর জন্য দুধ ডিম মাছ ও মাংস খাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন সি এর ভূমিকা-
আয়রন যাতে শরীরে ভালোভাবে শোষিত হয় তার জন্য ভিটামিন সি প্রয়োজন। তাই আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে লেবু কমলা পেয়ারা টমেটো বা অন্যান্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খেলে আয়রন শোষণ বাড়ে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার চিকিৎসা-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ও ফোলিক এসিড ট্যাবলেট খেতে হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে ইনজেকশন বা রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা ও শিশুর বিকাশ-
মায়ের শরীরে রক্তশূন্যতা থাকলে শিশুর জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। এতে শিশুর বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায় ও মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব পড়ে। জন্মের পর শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা ও প্রসব-
প্রসবের সময় কিছু রক্তক্ষরণ স্বাভাবিক। কিন্তু গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের শরীরে আগে থেকেই রক্তশূন্যতা থাকে তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে প্রাণঘাতী জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই প্রসবের আগেই রক্তশূন্যতার চিকিৎসা করা অপরিহার্য।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে করণীয়-
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা
প্রতিদিন আয়রন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া
অতিরিক্ত চা ও কফি কমানো
পর্যাপ্ত পানি পান করা
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিয়মিত বিশ্রাম নেওয়া।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা ও জীবনধারা-
খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা জরুরি। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা পর্যাপ্ত ঘুমানো ধূমপান বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা এবং মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কখন বেশি হয়-
গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে রক্তশূন্যতার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময় শিশুর বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং মায়ের শরীরে রক্তের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। তাই এই সময়ে বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরি।
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা একটি সাধারণ স্বাস্থ্যসমস্যা হলেও এটি অবহেলা করলে মা ও শিশুর জীবনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তাই শুরু থেকেই সচেতন থাকা জরুরি। প্রতিদিন সুষম খাদ্য গ্রহণ করা আয়রন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ নেওয়ার মাধ্যমে সহজেই এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়।
প্রশ্নোত্তর-
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা হলে কী হয়?
মা দুর্বল হয়ে পড়েন, শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে কী খাওয়া উচিত?
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন লাল মাংস মাছ ডিম শাকসবজি ও ফল খাওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার লক্ষণ কী?
দুর্বলতা মাথা ঘোরা শ্বাসকষ্ট ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এবং ক্লান্তি।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা কি শিশুর ক্ষতি করে?
হ্যাঁ এতে শিশুর ওজন কমে যেতে পারে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়।
আয়রন ট্যাবলেট কখন খাওয়া উচিত?
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া উচিত।