শিশুর ডায়রিয়া কী-
শিশুর ডায়রিয়া হলো এক ধরনের পেটের অসুখ যেখানে শিশু বারবার পাতলা পায়খানা করে। সাধারণত দিনে তিনবার বা তার বেশি পাতলা মলত্যাগকে ডায়রিয়া বলা হয়। এটি শিশুদের মধ্যে একটি সাধারণ রোগ হলেও অবহেলা করলে পানিশূন্যতা ও মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ার সাধারণ কারণ-
শিশুর ডায়রিয়ার নানা কারণ থাকতে পারে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ভাইরাস সংক্রমণ বিশেষ করে রোটা ভাইরাসের কারণে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী সংক্রমণও ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। অপরিষ্কার পানি বা খাবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অপরিষ্কার হাত মুখে আঙুল দেওয়া বা নতুন খাবার হঠাৎ খাওয়া থেকেও শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ার লক্ষণ-
শিশুর ডায়রিয়া হলে শুধু পাতলা মল নয়, আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন –
- বারবার মলত্যাগ হওয়া
- জ্বর হওয়া
- বমি হওয়া
- পেট ব্যথা বা ক্র্যাম্প
- শিশুর দুর্বল লাগা
- চোখ বসে যাওয়া
- ঠোঁট ও জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
শিশুর ডায়রিয়ার ঝুঁকি-
ডায়রিয়া বেশি হলে শিশুর শরীরে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। এতে পানিশূন্যতা হয় এবং শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়ে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ডায়রিয়া অন্যতম মৃত্যুঝুঁকির কারণ। বিশেষ করে যদি দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে শিশু মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
শিশুর ডায়রিয়া হলে করণীয়-
শিশুর ডায়রিয়া হলে প্রথমেই ঘরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হবে। শিশুকে পর্যাপ্ত পানি খাওয়াতে হবে যাতে শরীরে পানিশূন্যতা না হয়। ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন) খাওয়ানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি শিশুকে স্যুপ, ডাবের পানি, ভাতের মাড়, দুধ ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ায় ওআরএস এর গুরুত্ব-
শিশুর ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে লবণ ও পানি বের হয়ে যায়। এটি পূরণ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ওআরএস খাওয়ানো। ওআরএস সহজে তৈরি ও ব্যবহারযোগ্য এবং শিশুর শরীরে দ্রুত পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করে। যদি ওআরএস না পাওয়া যায় তবে এক লিটার পানিতে আধা চা চামচ লবণ ও ছয় চা চামচ চিনি মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ায় খাবার-
অনেকেই মনে করেন ডায়রিয়া হলে শিশুকে না খাওয়ানো উচিত। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। বরং শিশুকে হালকা ও সহজপাচ্য খাবার দিতে হবে। যেমন – ভাতের মাড়, খিচুড়ি, আলু সেদ্ধ, কলা, দুধ (যদি সহনশীল হয়) এবং শাকসবজির স্যুপ। এতে শরীর দুর্বল হয় না এবং দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।
শিশুর ডায়রিয়ায় কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত-
ডায়রিয়ার সময় শিশুকে ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার, তেলেভাজা খাবার, কাঁচা খাবার বা রাস্তার খাবার খাওয়ানো উচিত নয়। কারণ এগুলো ডায়রিয়া আরও বাড়াতে পারে। এছাড়া শিশুকে কোল্ড ড্রিঙ্কস বা কৃত্রিম জুস খাওয়ানোও এড়িয়ে চলা উচিত।
শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধ-
শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে কয়েকটি সহজ বিষয় মেনে চলতে হবে –
- শিশুকে সবসময় ফুটানো পানি খাওয়ানো
- হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকা
- শিশুকে ভ্যাকসিন (রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন) দেওয়া
- খাবার ও বাসন সবসময় পরিষ্কার রাখা
- শিশুকে সঠিক বয়সে সুষম খাবার খাওয়ানো
শিশুর ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতা-
ডায়রিয়ার সবচেয়ে বড় জটিলতা হলো পানিশূন্যতা। পানিশূন্যতা হলে শিশুর চোখ বসে যায়, জিহ্বা শুকিয়ে যায়, কান্নার সময় চোখের পানি বের হয় না এবং শিশুটি অলস হয়ে পড়ে। তাই এসব লক্ষণ দেখলেই দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
শিশুর ডায়রিয়ায় কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত-
শিশুর ডায়রিয়া কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেরে যেতে পারে, তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। যেমন –
- শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হলে
- শিশুর ডায়রিয়া তিন দিনের বেশি চললে
- প্রচণ্ড জ্বর থাকলে
- রক্ত বা শ্লেষ্মা মিশ্রিত মল হলে
- শিশু খেতে বা দুধ পান করতে অস্বীকার করলে
- শিশুর শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে
শিশুর ডায়রিয়া ও ভ্যাকসিন-
রোটা ভাইরাস হলো শিশুদের ডায়রিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। এ ভাইরাস প্রতিরোধে রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ভ্যাকসিন শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ডায়রিয়ার ঝুঁকি কমায়।
শিশুর ডায়রিয়ার ঘরোয়া যত্ন-
শিশুর ডায়রিয়ার সময় ঘরোয়া যত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে সবসময় পরিষ্কার রাখা, নরম কাপড় পরানো এবং বারবার হাত-মুখ ধোয়া দরকার। শিশুকে আরামদায়ক পরিবেশে রাখা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া জরুরি।
শিশুর ডায়রিয়া ও স্তন্যপান-
যদি শিশু মায়ের দুধ পান করে তবে ডায়রিয়ার সময়ও স্তন্যপান চালিয়ে যেতে হবে। মায়ের দুধ শুধু শিশুকে শক্তি দেয় না, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায় এবং পানিশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
শিশুর ডায়রিয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব-
বারবার ডায়রিয়া হলে শিশুর ওজন কমে যেতে পারে, অপুষ্টি দেখা দিতে পারে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই ডায়রিয়াকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়।
উপসংহার-
শিশুর ডায়রিয়া একটি সাধারণ কিন্তু অবহেলা করার মতো নয়। সময়মতো সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা পেলে শিশু দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তাই অভিভাবকদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, শিশুর শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সঠিক যত্ন ও সচেতনতার মাধ্যমেই শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও মোকাবিলা সম্ভব।
প্রশ্নোত্তর-
শিশুর ডায়রিয়া হলে কী করা উচিত?
শিশুকে পর্যাপ্ত পানি ও ওআরএস খাওয়াতে হবে এবং সহজপাচ্য খাবার খাওয়াতে হবে।
শিশুর ডায়রিয়া কত দিনে ভালো হয়?
সাধারণত ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সেরে যায়।
শিশুর ডায়রিয়ার সময় দুধ খাওয়ানো যাবে কি?
হ্যাঁ, মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া উচিত। এটি শিশুর জন্য উপকারী।
শিশুর ডায়রিয়া হলে কখন চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে?
যদি শিশুর বয়স ছয় মাসের কম হয়, প্রচণ্ড জ্বর থাকে, রক্তমিশ্রিত মল হয় বা পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয় তবে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায় কীভাবে?
শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ফুটানো পানি খাওয়ানো, হাত ধোয়ার অভ্যাস করানো এবং ভ্যাকসিন দেওয়া ডায়রিয়া প্রতিরোধে সহায়ক।