গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার: পরিচিতি-
গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এই সময়ে মায়ের শরীরে নানা পরিবর্তন ঘটে, যার মধ্যে রক্তচাপের পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অনেক নারীর ক্ষেত্রে দেখা দেয় গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার। এটি শুধুমাত্র মায়ের নয়, অনাগত শিশুর জন্যও বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার কী-
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার বলতে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া বোঝায়। সাধারণভাবে যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি. পারদ বা তার বেশি হয়, তবে সেটিকে হাইপ্রেসার বলা হয়। গর্ভাবস্থায় এটি স্বাভাবিক থেকে ভিন্ন একটি অবস্থা এবং অনেক সময় তা বিপজ্জনক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের ধরন-
চিকিৎসা বিজ্ঞানে গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের কয়েকটি ধরন রয়েছে:
- গেস্টেশনাল হাইপ্রেসার
এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর দেখা দেয় এবং প্রসবের পর সেরে যায়। - ক্রনিক হাইপ্রেসার
গর্ভাবস্থার আগে থেকেই বা গর্ভাবস্থার প্রথম ২০ সপ্তাহের মধ্যে যদি হাইপ্রেসার থাকে তবে এটিকে ক্রনিক হাইপ্রেসার বলা হয়। - প্রি-এক্লাম্পসিয়া
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের সবচেয়ে গুরুতর রূপ হলো প্রি-এক্লাম্পসিয়া। এ সময় রক্তচাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রস্রাবে প্রোটিন বের হয় এবং শরীরে নানা জটিলতা তৈরি করে। - এক্লাম্পসিয়া
প্রি-এক্লাম্পসিয়ার অবহেলার কারণে খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি জটিল অবস্থা তৈরি হয়। এটি মা ও শিশুর জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের কারণ-
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। সেগুলো হলো:
- বংশগত প্রভাব
- বয়স বেশি হলে (৩৫ বছরের বেশি)
- স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন
- যমজ বা একাধিক সন্তান ধারণ
- প্রথমবার গর্ভধারণ
- ডায়াবেটিস
- কিডনির সমস্যা
- মানসিক চাপ ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের লক্ষণ-
অনেক সময় গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার কোনো লক্ষণ ছাড়াই হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- মাথাব্যথা
- চোখে ঝাপসা দেখা
- হঠাৎ হাত, পা ও মুখ ফুলে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- বমি বমি ভাব বা বমি
- হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি
- পেটের ডান পাশে ব্যথা
এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারকে জানানো জরুরি।
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের ঝুঁকি-
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার অবহেলা করলে মা ও ভ্রূণের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
- প্লাসেন্টায় রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া
- শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া
- অকাল প্রসব
- কম ওজনের শিশু জন্ম
- গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসব
- প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি
- মায়ের কিডনি ও লিভারের ক্ষতি
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের জটিলতা-
- প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা প্লাসেন্টা অ্যাব্রাপশন (প্লাসেন্টা আলাদা হয়ে যাওয়া)
- রক্ত জমাট বাঁধা
- মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি
- দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের প্রবণতা বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার নির্ণয়-
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ মাপা জরুরি। চিকিৎসক সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষা করেন:
- রক্তচাপ পরীক্ষা
- প্রস্রাবে প্রোটিন টেস্ট
- রক্ত পরীক্ষা (লিভার, কিডনি ফাংশন)
- আল্ট্রাসনোগ্রাম (শিশুর বৃদ্ধি ও প্লাসেন্টার অবস্থা বোঝার জন্য)
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের চিকিৎসা-
হাইপ্রেসারের চিকিৎসা নির্ভর করে এর মাত্রা ও জটিলতার ওপর।
- নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা
- ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন (সেফ অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ)
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম
- সুষম খাদ্য গ্রহণ
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ
- নিয়মিত প্রেগন্যান্সি চেকআপ
যদি হাইপ্রেসার গুরুতর হয়, তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বিশেষ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের সময়ে করণীয়-
- লবণ গ্রহণ কমাতে হবে
- প্রচুর পানি পান করতে হবে
- নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে
- স্ট্রেস কমানোর চেষ্টা করতে হবে
- ধূমপান ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে
- নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার প্রতিরোধ-
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার পুরোপুরি প্রতিরোধ করা না গেলেও ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
- গর্ভধারণের আগে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া
- নিয়মিত ব্যায়াম
- ডায়াবেটিস বা কিডনির রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা
- পরিবারে হাইপ্রেসারের ইতিহাস থাকলে গর্ভধারণের আগে ডাক্তারকে জানানো
- প্রেগন্যান্সির সময় নিয়মিত চেকআপ করা
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার ও খাদ্যাভ্যাস-
সঠিক খাদ্যাভ্যাস রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
- বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া
- কম চর্বি ও কম তেলযুক্ত খাবার গ্রহণ
- অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলা
- প্রসেসড খাবার এড়িয়ে চলা
- ক্যালসিয়াম ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার নিয়ে সচেতনতা-
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার একটি গুরুতর বিষয় হলেও সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। গর্ভবতী মা যদি নিয়মিত চেকআপ করেন, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলেন এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনেন তবে মা ও শিশু উভয়েই সুস্থ থাকতে পারে।
গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসারের স্বাভাবিক মাত্রা কত?
উত্তর: সাধারণত রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি. পারদের বেশি হলে তাকে হাইপ্রেসার বলা হয়।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার হলে কি স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব?
উত্তর: হাইপ্রেসারের মাত্রা ও জটিলতার ওপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে সিজারিয়ান প্রসব প্রয়োজন হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার কি শিশুর জন্য বিপজ্জনক?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে, অকাল প্রসব বা মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রশ্ন ৪: হাইপ্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কি ওষুধ খাওয়া নিরাপদ?
উত্তর: ডাক্তার সেফ অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, যেগুলো গর্ভাবস্থায় নিরাপদ। নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন ৫: গর্ভাবস্থায় হাইপ্রেসার প্রতিরোধ করা যায় কীভাবে?
উত্তর: স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত চেকআপ করা এবং স্ট্রেস কমানো এর প্রতিরোধে সহায়ক।