ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয়-
সন্তান আল্লাহর একটি অমূল্য নেয়ামত। নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারে খুশির বার্তা বয়ে আনে। তবে শুধু খুশি হওয়াই যথেষ্ট নয়, ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে যা নবজাতককে ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার প্রথম ধাপ। এই দায়িত্বগুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এতে নিহিত রয়েছে সন্তানের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ।
এই ব্লগে আমরা ধাপে ধাপে আলোচনা করবো ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয় বিষয়গুলো, এর গুরুত্ব, এবং এর সাথে জড়িত কিছু সাধারণ প্রশ্নোত্তর। (ইসলামে শিশু পরিচর্যা: কুরআন ও হাদীসের আলোকে সঠিক দিকনির্দেশনা)
সন্তান জন্মের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়-
নবজাতক পৃথিবীতে আসার পর সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা জরুরি।
আল্লাহ বলেছেন—
“যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বেশি দেব।” (সূরা ইবরাহীম: ৭)
সন্তান সুস্থভাবে জন্ম নিলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একজন মুমিন অভিভাবকের প্রথম কর্তব্য।
কানে আযান ও ইকামত দেওয়া-
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সন্তানের ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত দিয়েছেন। এতে শিশুর কানে প্রথম যে শব্দ প্রবেশ করে তা হলো আল্লাহর মহত্ত্বের ডাক।
- ডান কানে আযান
- বাম কানে ইকামত
এটি সন্তানের অন্তরে ইসলামের প্রতি প্রথম সংযোগ স্থাপন করে।
তাহনিক করানো-
তাহনিক হলো—নবজাতকের মুখে খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবানো অবস্থায় লাগানো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ হাতে অনেক নবজাতকের তাহনিক করতেন।
এতে রয়েছে দু’টি উপকারিতা:
১. শিশুর মুখে মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে পরিচয় হয়।
২. শরীরে প্রথমবার শক্তির যোগান পাওয়া যায়।
শিশুর নামকরণ-
ইসলামে সন্তানের জন্য সুন্দর নাম রাখা অত্যন্ত জরুরি। নাম রাখার সময় আল্লাহর বান্দা, নবী-রাসূল, সাহাবিদের নাম অনুসরণ করা উত্তম।
- আল্লাহর বান্দা দিয়ে শুরু হওয়া নাম: যেমন আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান
- নবী-রাসূলের নাম: যেমন ইব্রাহীম, মুসা, মুহাম্মদ
- সাহাবিদের নাম: যেমন উমর, আলী, আয়েশা, ফাতিমা
রাসূল (সাঃ) বলেছেন:
“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সুন্দর নাম দাও।” (আবু দাউদ)
আকীকা দেওয়া-
আকীকা হলো সন্তানের জন্ম উপলক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি Sunnah কাজ। সাধারণত সপ্তম দিনে আকীকা করা উত্তম।
- ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি ছাগল বা ভেড়া কুরবানি।
- মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল বা ভেড়া কুরবানি।
এ সময় সন্তানের মাথার চুল মুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সমপরিমাণ রুপা বা সোনা সদকা করা হয়।
মাথার চুল ফেলা-
আকীকার দিন শিশুর মাথার চুল ফেলে দেওয়া Sunnah। এরপর ওজন অনুযায়ী রুপা সদকা করা হয়। যেমন, চুলের ওজন যদি ৫০ গ্রাম হয়, তবে ৫০ গ্রাম রুপার সমমূল্যের টাকা দান করতে হবে।
খতনা করা-
খতনা করানো সুন্নত। কোনো কোনো হাদিসে জন্মের সপ্তম দিনে খতনা করানোর কথা এসেছে। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) হাসান এবং হুসাইনের সপ্তম দিন আকিকা দিয়েছেন এবং খতনা করিয়েছেন। (তবরানি)। মূলত খতনার বয়স জন্মের এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হয়। তবে সাবালক হওয়ার আগে করে ফেলার ব্যাপারে মত দিয়েছেন অধিকাংশ আলিম।
স্তন্যপান করানো-
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন—
“মায়েরা তাদের সন্তানকে পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে।” (সূরা বাকারা: ২৩৩)
নবজাতকের প্রথম খাবার হওয়া উচিত মায়ের দুধ। এতে রয়েছে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির শক্তি।
সদকাহ দেওয়া-
সন্তান জন্মের খুশিতে গরীব-দুঃখীদের মাঝে সদকা করা উত্তম কাজ। এতে শিশুর জন্য আল্লাহর রহমত নাজিল হয় এবং পরিবারের ওপর কল্যাণ বৃদ্ধি পায়।
ওজু ও নামাজে যত্নবান হওয়া-
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরিবারে আনন্দের আবহ তৈরি হয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, অভিভাবকের প্রথম দায়িত্ব হলো আল্লাহর আদেশ মেনে চলা। বাবা-মা যতটা ধর্মভীরু হবেন, সন্তানও ততটা ইসলামী আদর্শে গড়ে উঠবে।
ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয়র গুরুত্ব-
এই প্রতিটি কাজের মধ্যে শুধু আধ্যাত্মিক কল্যাণ নয়, বরং শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার উপকারিতাও রয়েছে। ইসলাম যে বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও আজ তার গুরুত্ব প্রমাণ করছে। যেমন—শিশুর প্রথম খাবার হিসেবে মায়ের দুধ, বা খতনার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা।
উপসংহার-
সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা ও দায়িত্ব। ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয় বিষয়গুলো পালন করা শুধু Sunnah নয়, বরং এটি সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ। একজন অভিভাবক যদি প্রথম থেকেই সন্তানের প্রতি ইসলামের নিয়ম মেনে চলে, তবে সেই সন্তান নৈতিকতা, ঈমান এবং আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ হয়ে বেড়ে ওঠে।
ইসলামে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয় সম্পর্কিত প্রশ্নত্তোর-
১. নবজাতকের কানে আযান দেওয়া কতটা জরুরি?
হ্যাঁ, এটি সুন্নাহ। সন্তানের কানে প্রথমবার আল্লাহর ডাক পৌঁছানো অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ।
২. আকীকা না দিলে কি গুনাহ হবে?
না, আকীকা করা সুন্নাহ। তবে করা উত্তম, এতে সন্তানের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
৩. সন্তানের নামকরণ কখন করা উচিত?
সাধারণত সপ্তম দিনে নামকরণ করা উত্তম। তবে জন্মের পরপরই নাম রাখা জায়েজ।
৪. মেয়ে সন্তানের জন্য আকীকা কেমন হবে?
মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল বা ভেড়া আকীকা করতে হয়।
৫. খতনা করার সঠিক সময় কখন?
খতনা ছোট বয়সেই করানো উত্তম। সাধারণত কয়েক মাস বয়সে করানো নিরাপদ ও সহজ।