গর্ভাবস্থায় যক্ষা: একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা-
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়। এ সময়ে দেহে নানা ধরনের হরমোন পরিবর্তন ঘটে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে মা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। এমনই একটি রোগ হলো যক্ষা বা টিউবারকুলোসিস (TB)। গর্ভাবস্থায় যক্ষা কেবল মায়ের জন্য নয়, অনাগত শিশুর জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় যক্ষা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রতিটি নারীর জন্য জরুরি। (গর্ভাবস্থায় সর্দি কাশি: কারণ, ঝুঁকি, প্রতিকার ও ঘরোয়া সমাধান)
যক্ষা কী এবং কিভাবে ছড়ায়?-
যক্ষা হলো Mycobacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট একটি সংক্রামক রোগ। সাধারণত ফুসফুসে প্রভাব ফেলে, তবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও ছড়াতে পারে। এটি বাতাসের মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি বা হাঁচি দিলে যক্ষার জীবাণু বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং তা অন্য কেউ শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে সংক্রমণ ঘটতে পারে।
গর্ভবতী মা যদি যক্ষায় আক্রান্ত হন, তাহলে তাঁর শারীরিক দুর্বলতা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শ্বাসকষ্ট, অপুষ্টি ও অন্যান্য জটিলতা তৈরি হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যক্ষার কারণ-
গর্ভাবস্থায় যক্ষা হওয়ার মূল কারণ অন্যদের মতোই—সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা। তবে গর্ভবতী নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন কারণ:
১. গর্ভাবস্থায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
২. মায়ের শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে।
৩. অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতা যক্ষার ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. যদি পরিবারের কারো যক্ষা থাকে, সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি।
৫. অতীতে যক্ষায় আক্রান্ত হলে পুনরায় সক্রিয় হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যক্ষার লক্ষণ-
গর্ভাবস্থায় যক্ষা চিহ্নিত করা কঠিন হতে পারে কারণ কিছু উপসর্গ গর্ভাবস্থার সাধারণ সমস্যার মতো দেখায়। তবুও যক্ষার সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
১. দীর্ঘস্থায়ী শুকনো কাশি (তিন সপ্তাহ বা তার বেশি)।
২. জ্বর, বিশেষ করে সন্ধ্যায় বা রাতে।
৩. রাতে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া।
৪. শরীর দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া ও ওজন কমে যাওয়া।
৫. অবসাদ ও দুর্বলতা।
৬. বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট।
৭. কখনও কাশির সাথে রক্ত আসা।
গর্ভাবস্থায় যক্ষার ঝুঁকি-
গর্ভাবস্থায় যক্ষা শুধু মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, শিশুর জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ঝুঁকিগুলো হলো:
মায়ের জন্য ঝুঁকি
- রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টি।
- প্রি-টার্ম লেবার (অকাল প্রসব)।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট।
- চিকিৎসা না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি।
শিশুর জন্য ঝুঁকি
- গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে।
- মৃত সন্তান জন্ম নেওয়া।
- অকাল প্রসব।
- কম ওজনের শিশু জন্ম।
- শিশুর জন্মগত যক্ষা হওয়ার ঝুঁকি।
গর্ভাবস্থায় যক্ষা নির্ণয়ের উপায়-
যক্ষা নির্ণয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা করা হয়। তবে গর্ভাবস্থায় সব পরীক্ষা নিরাপদ নয়। চিকিৎসক সাধারণত নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করেন:
- চেস্ট এক্স-রে: বিশেষ সতর্কতা নিয়ে করা হয়, যেমন সীসার অ্যাপ্রন ব্যবহার।
- স্পুটাম টেস্ট: কফের নমুনা পরীক্ষা করে জীবাণু শনাক্ত করা হয়।
- মন্টু টেস্ট: ত্বকের নিচে যক্ষার জীবাণুর প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা।
- রক্ত পরীক্ষা: সাধারণ শারীরিক অবস্থা বোঝার জন্য।
গর্ভাবস্থায় যক্ষার চিকিৎসা-
গর্ভাবস্থায় যক্ষা নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক। যক্ষার চিকিৎসায় সাধারণত ৬ মাস বা তার বেশি সময় ধরে একাধিক অ্যান্টি-টিবি ওষুধ খেতে হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি হলো:
১. DOTS প্রোগ্রাম অনুযায়ী চিকিৎসা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময় ধরে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়।
২. নিরাপদ ওষুধ ব্যবহার: গর্ভাবস্থায় Isoniazid, Rifampicin, Ethambutol সাধারণত নিরাপদ ধরা হয়। তবে Streptomycin এড়িয়ে চলা হয় কারণ এটি শিশুর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৩. পুষ্টিকর খাদ্য: চিকিৎসার পাশাপাশি গর্ভবতী মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার অত্যন্ত জরুরি।
৪. নিয়মিত ফলো-আপ: চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় যক্ষার প্রভাব প্রতিরোধ-
যক্ষা প্রতিরোধ সবসময় চিকিৎসার চেয়ে ভালো। গর্ভাবস্থায় যক্ষা প্রতিরোধের জন্য কিছু কার্যকর পদক্ষেপ হলো:
১. যক্ষায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
২. কাশি-হাঁচির সময় মুখ ঢেকে রাখা।
৩. বাসা-বাড়ি সবসময় খোলা-ছাদ ও বাতাস চলাচল উপযোগী রাখা।
৪. সুষম খাদ্য খাওয়া, বিশেষ করে প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার।
৫. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
৬. BCG ভ্যাকসিন যক্ষার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়, তাই শিশুদের টিকা দেওয়া জরুরি।
গর্ভাবস্থায় যক্ষা ও শিশুর যত্ন-
যদি গর্ভবতী মা যক্ষায় আক্রান্ত হন, তবে নবজাতক শিশুকেও বিশেষ যত্নে রাখতে হয়। শিশুর টিকাদান অবশ্যই সময়মতো করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক শিশুকে প্রতিরোধমূলক ওষুধও দিতে পারেন।
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় যক্ষা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও যত্নের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গর্ভবতী মায়ের যক্ষা চিকিৎসা না করলে মা ও শিশুর উভয়ের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সচেতনতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই হতে পারে যক্ষা প্রতিরোধ ও নিরাময়ের প্রধান উপায়।
প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় যক্ষা হলে কি শিশুর ক্ষতি হয়?
হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় যক্ষা হলে শিশুর গর্ভপাত, অকাল প্রসব বা কম ওজন নিয়ে জন্মানোর ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় যক্ষার চিকিৎসা কি নিরাপদ?
হ্যাঁ, বেশ কিছু অ্যান্টি-টিবি ওষুধ গর্ভাবস্থায় নিরাপদ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া উচিত।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় যক্ষা নির্ণয়ে এক্স-রে কি করা যায়?
হ্যাঁ, তবে সুরক্ষার জন্য সীসার অ্যাপ্রন ব্যবহার করা হয় যাতে শিশুর ক্ষতি না হয়।
প্রশ্ন: যক্ষায় আক্রান্ত মা কি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন?
হ্যাঁ, চিকিৎসকের অনুমতি সাপেক্ষে যক্ষায় আক্রান্ত মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, তবে কাশি বা হাঁচির সময় মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি।
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় যক্ষা প্রতিরোধে কী কী করা যায়?
সুষম খাদ্য খাওয়া, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, যক্ষায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যক্ষা প্রতিরোধে সাহায্য করে।