শিশুদের স্ক্যাবিস: কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

শিশুদের স্ক্যাবিস-

ত্বকের রোগের মধ্যে শিশুদের স্ক্যাবিস একটি সাধারণ সমস্যা। স্ক্যাবিস হলো এক ধরনের সংক্রামক চর্মরোগ, যা সারকপটিস স্ক্যাবিয়াই (Sarcoptes scabiei) নামক মাইট দ্বারা সৃষ্ট। এ রোগে ত্বকে তীব্র চুলকানি, ফুসকুড়ি, ছোট ছোট ফোঁড়া, লালচে দাগ এবং অসহ্য অস্বস্তি দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক দুর্বল এবং তারা একসঙ্গে খেলাধুলা বা ঘুমানোর সময় সহজেই একে অপরের সংস্পর্শে আসে।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব—শিশুদের স্ক্যাবিসের কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা, প্রতিরোধ এবং প্রয়োজনীয় ঘরোয়া টিপস।

 স্ক্যাবিস কী?-

স্ক্যাবিস হলো ত্বকের এমন একটি সংক্রমণ যেখানে মাইট (এক ধরনের ক্ষুদ্র পরজীবী) ত্বকের ভেতরে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং সেখানে বসবাস শুরু করে। এর ফলে ত্বকে প্রচণ্ড চুলকানি ও র‍্যাশ হয়।

শিশুদের স্ক্যাবিসের কারণ-

শিশুদের স্ক্যাবিসের প্রধান কারণ হলো Sarcoptes scabiei নামক মাইট। এগুলো এত ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। শিশুদের মধ্যে এ রোগ ছড়ানোর সাধারণ কারণগুলো হলো:

  • ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শ – একসাথে খেলা, ঘুমানো বা কাপড় শেয়ার করা।
  • অপরিষ্কার পরিবেশ – অপরিষ্কার বিছানা, বালিশ বা পোশাক ব্যবহার।
  • অপরিচ্ছন্নতা – শিশুর শরীর নিয়মিত না ধোয়া বা নোংরা পোশাক পরা।
  • সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে সংস্পর্শে আসা – পরিবারে কারও স্ক্যাবিস থাকলে শিশুর মধ্যেও দ্রুত ছড়ায়।

শিশুদের স্ক্যাবিসের উপসর্গ-

শিশুদের স্ক্যাবিসের উপসর্গ অন্যান্য চর্মরোগের সঙ্গে মিলে যায়। তবে কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে যা স্ক্যাবিসকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে:

  • তীব্র চুলকানি – বিশেষ করে রাতে চুলকানি বেড়ে যায়।
  • ছোট ছোট লাল ফুসকুড়ি বা ফোঁড়া – আঙুলের ফাঁক, কবজি, কনুই, বগল, কোমর, নাভি, হাঁটু, যৌনাঙ্গ ও নিতম্বে বেশি দেখা যায়।
  • ত্বকে পাতলা রেখার মতো দাগ – যা আসলে মাইটের তৈরি সুড়ঙ্গ।
  • ত্বক ফেটে যাওয়া ও ঘা হওয়া – অতিরিক্ত চুলকানোর ফলে।
  • শিশুর অস্থিরতা – রাতে ঘুমাতে না পারা, বিরক্তি, কান্না।

শিশুদের স্ক্যাবিসে জটিলতা-

চিকিৎসা না করলে স্ক্যাবিস শিশুদের জন্য জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। যেমন—

  • ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন – খোঁচানোর ফলে ক্ষতস্থানে জীবাণু ঢুকে যায়।
  • ত্বকের ঘা ও আলসার – চুলকাতে চুলকাতে ঘা হয়ে যায়।
  • নিদ্রাহীনতা ও মানসিক অস্থিরতা – রাতের ঘুম নষ্ট হওয়ায় শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • অন্যদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া – পরিবার ও স্কুলের অন্যান্য শিশুদের আক্রান্ত করে।

শিশুদের স্ক্যাবিস নির্ণয়-

শিশুদের স্ক্যাবিস সাধারণত ডাক্তার শারীরিক পরীক্ষা ও ইতিহাস শুনেই শনাক্ত করতে পারেন। কখনো কখনো আক্রান্ত ত্বক থেকে সামান্য চামড়া সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে দেখা হয়, যাতে মাইট বা ডিম শনাক্ত করা যায়।

শিশুদের স্ক্যাবিস চিকিৎসা-

১. ঔষধি চিকিৎসা

  • পারমেথ্রিন ক্রিম (Permethrin 5%) – শিশুদের স্ক্যাবিসের সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ ওষুধ। সারা শরীরে (মাথা থেকে পা পর্যন্ত) মাখিয়ে ৮-১২ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলতে হয়।
  • বেনজাইল বেনজোয়েট লোশন – শিশুদের ক্ষেত্রে কম ঘনত্ব ব্যবহার করা হয়।
  • সালফার মলম (Sulphur ointment) – ছোট শিশুদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ।
  • অ্যান্টিহিস্টামিন সিরাপ/ট্যাবলেট – তীব্র চুলকানি কমাতে ব্যবহৃত হয়।

২. গৃহস্থালি চিকিৎসা

  • আক্রান্ত শিশুর পোশাক, চাদর, বালিশ কভার গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে।
  • সংক্রমিত শিশুকে আলাদা রাখতে হবে যতক্ষণ না চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়।
  • নখ ছোট করে কেটে দিতে হবে যেন চুলকানোর সময় ত্বক না ফাটে।

শিশুদের স্ক্যাবিস প্রতিরোধ-

  • শিশুকে নিয়মিত গোসল করানো।
  • প্রতিদিন পরিষ্কার পোশাক পরানো।
  • সংক্রমিত শিশুর সঙ্গে অন্য শিশুদের দূরে রাখা।
  • পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে চিকিৎসা করা উচিত।
  • শিশুর খেলনা, বিছানা, পোশাক জীবাণুমুক্ত করা।

শিশুদের স্ক্যাবিসে ঘরোয়া প্রতিকার-

কিছু ঘরোয়া উপায় চুলকানি কমাতে সাহায্য করতে পারে, তবে এগুলো চিকিৎসার বিকল্প নয়:

  • নিমপাতার পানি – অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণাগুণ আছে।
  • হলুদের পেস্ট – চুলকানি ও প্রদাহ কমাতে সহায়ক।
  • অ্যালো ভেরা জেল – ত্বক ঠাণ্ডা রাখে ও আরাম দেয়।

শিশুদের স্ক্যাবিস সম্পর্কিত ভুল ধারণা-

  • অনেকে মনে করেন স্ক্যাবিস নোংরা মানুষের রোগ—এটা সঠিক নয়। পরিচ্ছন্ন পরিবারেও স্ক্যাবিস হতে পারে।
  • আবার অনেকে ভাবেন স্ক্যাবিস শুধুই চুলকানি—কিন্তু আসলে এটি সংক্রামক ও জটিল হতে পারে।
  • ভেষজ চিকিৎসায় স্ক্যাবিস সম্পূর্ণ সারানো যায় না, শুধুমাত্র উপসর্গ কিছুটা কমে।

শিশুদের স্ক্যাবিসে অভিভাবকের করণীয়-

  • শিশুর মধ্যে স্ক্যাবিসের উপসর্গ দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
  • শিশুকে অন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে।
  • চিকিৎসকের নির্দেশ মতো পুরো সময় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, মাঝপথে বন্ধ করা যাবে না।
  • শিশুর মানসিক যত্ন নিতে হবে, কারণ স্ক্যাবিসে শিশু অস্থির ও রাগী হয়ে পড়ে।

উপসংহার-

শিশুদের স্ক্যাবিস একটি সংক্রামক ও কষ্টদায়ক ত্বকের রোগ। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুর উপসর্গ দেখামাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং নির্দিষ্ট চিকিৎসা মেনে চলা। পরিচ্ছন্নতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে স্ক্যাবিস থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।

প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: শিশুদের স্ক্যাবিস কী কারণে হয়?
উত্তর: শিশুদের স্ক্যাবিস মাইট নামক ক্ষুদ্র পরজীবীর কারণে হয়, যা ত্বকের ভেতরে সুড়ঙ্গ তৈরি করে ডিম পাড়ে।

প্রশ্ন ২: শিশুদের স্ক্যাবিসে সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ কী?
উত্তর: সাধারণত পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম শিশুদের স্ক্যাবিস চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ।

প্রশ্ন ৩: শিশুদের স্ক্যাবিস কি সংক্রামক?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি খুব দ্রুত ছড়ায়। আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে এলে অন্য শিশু বা পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হতে পারে।

প্রশ্ন ৪: শিশুদের স্ক্যাবিস সারতে কতদিন লাগে?
উত্তর: সাধারণত সঠিক চিকিৎসা নিলে ১-২ সপ্তাহের মধ্যে উপসর্গ কমে যায়, তবে পুরোপুরি ভালো হতে ৩-৪ সপ্তাহও লাগতে পারে।

প্রশ্ন ৫: শিশুদের স্ক্যাবিস প্রতিরোধে কী করা যায়?
উত্তর: শিশুর পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পোশাক-চাদর নিয়মিত পরিষ্কার করা, আক্রান্ত শিশুকে আলাদা রাখা এবং পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে চিকিৎসা করানো সবচেয়ে জরুরি।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top