প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তন: ভূমিকা-
প্রসব একটি নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার একটি। সন্তান জন্মের পর শুধু মানসিক নয়, শারীরিকভাবেও মায়ের শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। অনেক মা এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে অজ্ঞাত থাকেন এবং স্বাভাবিক ভেবে এড়িয়ে যান। অথচ প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকা খুবই জরুরি, কারণ এ সময় মায়ের শরীর পুনরুদ্ধারের পথে থাকে।
প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তনের ধাপ-
প্রথম ছয় সপ্তাহ – একে বলা হয় “পোস্টপার্টাম পিরিয়ড”, যেখানে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন হয়।
ছয় সপ্তাহ থেকে ছয় মাস – ধীরে ধীরে শরীর পূর্বাবস্থায় ফেরে।
ছয় মাস পর – দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিবর্তন রয়ে যেতে পারে, যেমন দেহের গঠন বা ত্বকের সমস্যা।
প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তনসমূহ-
জরায়ুর পরিবর্তন
প্রসবের সময় শিশুকে ধারণকারী জরায়ু বড় আকার ধারণ করে। সন্তান জন্মের পর এটি ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সাধারণত ৬ সপ্তাহের মধ্যে জরায়ু তার স্বাভাবিক আকারে চলে আসে। এ সময় হালকা ব্যথা বা টান লাগা স্বাভাবিক।
যোনি ও পেলভিক ফ্লোরের পরিবর্তন
প্রসবের পর যোনিপথ কিছুটা ঢিলে হয়ে যায়। বিশেষ করে নরমাল ডেলিভারির পর এ পরিবর্তন বেশি দেখা যায়। এছাড়া পেলভিক ফ্লোরের পেশি দুর্বল হয়ে যায়, ফলে প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা (Urinary incontinence) হতে পারে। এ সমস্যা কাটাতে কেগেল এক্সারসাইজ খুব কার্যকর।
রক্তপাত বা লোখিয়া
প্রসবের পর যোনি দিয়ে রক্তপাত হয়, যাকে বলা হয় লোখিয়া। প্রথমে রক্তের মতো হলেও ধীরে ধীরে এটি হালকা বাদামী ও পরে হলুদ স্রাবে পরিণত হয়। সাধারণত ৪-৬ সপ্তাহ পর্যন্ত এটি স্থায়ী হতে পারে।
স্তনের পরিবর্তন
প্রসবের পর দুধ উৎপাদন শুরু হয়। স্তন ভারী ও ফোলা অনুভূত হয়। অনেক সময় ব্যথা বা জ্বালাভাব দেখা দেয়, যাকে বলা হয় এনগর্জমেন্ট। শিশুকে নিয়মিত স্তন্যদান করলে এ সমস্যা কমে যায়।
হরমোনের পরিবর্তন
প্রসবের পর হরমোনের মাত্রা দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মাত্রা হ্রাস পায়, যার ফলে মেজাজ পরিবর্তন, ঘাম হওয়া, চুল পড়া, এমনকি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হতে পারে।
চুল ও ত্বকের পরিবর্তন
অনেক মা প্রসবের পর অতিরিক্ত চুল পড়ার সমস্যায় ভোগেন। ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, স্ট্রেচ মার্কস, ফোলা পেট ইত্যাদি পরিবর্তন স্বাভাবিক।
ওজন বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় ওজন বেড়ে যায়। প্রসবের পর কিছুটা কমলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। সঠিক ডায়েট ও ব্যায়াম ছাড়া ওজন কমানো কঠিন।
হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা
প্রসবের পর শরীরে হাড় ও জয়েন্টে ব্যথা দেখা যায়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর ঘাটতি এ সমস্যার অন্যতম কারণ।
ঘুম ও ক্লান্তি
নবজাতককে সামলাতে গিয়ে মায়েদের ঘুমের ঘাটতি হয়। সারাক্ষণ ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হয়।
মানসিক পরিবর্তন
শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিকভাবেও বড় পরিবর্তন ঘটে। অনেক মা দুঃখবোধ, হতাশা বা অস্থিরতায় ভোগেন, যাকে বলা হয় বেবি ব্লুজ। সচেতনতা ও পরিবারের সহায়তায় এ সমস্যা অনেকটাই কমে যায়।
প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তনের যত্ন-
১. সুষম খাবার খান – প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।
২. পর্যাপ্ত পানি পান করুন – শরীরকে হাইড্রেটেড রাখুন।
৩. হালকা ব্যায়াম করুন – বিশেষ করে কেগেল এক্সারসাইজ পেলভিক ফ্লোরকে শক্তিশালী করে।
৪. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন – শিশুর সাথে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
৫. স্তন্যদান চালিয়ে যান – এটি মায়ের শরীর ও শিশুর জন্য সমানভাবে উপকারী।
৬. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন – যদি অতিরিক্ত রক্তপাত, জ্বর বা তীব্র ব্যথা হয় তবে দেরি না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তনের সময়কাল-
জরায়ু স্বাভাবিক হতে লাগে ৬ সপ্তাহ।
চুল পড়া নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগে প্রায় ৬ মাস।
ওজন কমতে সময় লাগে ৬ মাস থেকে ১ বছর।
মানসিক স্থিতি ফিরে পেতে অনেকের সময় লাগে আরও বেশি।
প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তনের ঝুঁকি-
১. অতিরিক্ত রক্তপাত
২. উচ্চ রক্তচাপ
৩. প্রস্রাব বা মল নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
৪. তীব্র মানসিক হতাশা
৫. স্তনে ইনফেকশন বা মাষ্টাইটিস
এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
উপসংহার-
প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তন প্রতিটি মায়ের জন্য স্বাভাবিক বিষয়। তবে সচেতনতা, সঠিক যত্ন এবং চিকিৎসকের পরামর্শে এ পরিবর্তন সহজেই সামলানো সম্ভব। প্রতিটি মা’ই যেন নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হন এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন – এটাই সবচেয়ে জরুরি।
প্রশ্নত্তোর-
প্রশ্ন ১: প্রসবের পর শারীরিক পরিবর্তন কতদিন স্থায়ী হয়?
উত্তর: সাধারণত ৬ সপ্তাহের মধ্যে বেশিরভাগ পরিবর্তন স্বাভাবিক হয়ে যায়, তবে কিছু পরিবর্তন ৬ মাস বা তারও বেশি স্থায়ী হতে পারে।
প্রশ্ন ২: প্রসবের পর অতিরিক্ত চুল পড়া কি স্বাভাবিক?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয় এবং সাধারণত ৬ মাসের মধ্যে কমে যায়।
প্রশ্ন ৩: প্রসবের পর শরীর আগের মতো ফিরিয়ে আনতে কি করতে হবে?
উত্তর: সুষম খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও স্তন্যদান সবচেয়ে কার্যকর।
প্রশ্ন ৪: প্রসবের পর মানসিক হতাশা হলে কি করা উচিত?
উত্তর: পরিবারের সহায়তা নিন, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্রশ্ন ৫: প্রসবের পর ব্যথা বা রক্তপাত হলে কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর: যদি রক্তপাত অত্যধিক হয়, জ্বর আসে বা তীব্র ব্যথা হয় তবে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।