গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা: ভূমিকা-
গর্ভাবস্থা প্রতিটি নারীর জীবনে একটি বিশেষ সময়। এই সময়ে শরীরে নানা ধরণের পরিবর্তন ঘটে, যা অনেক সময় অস্বস্তিকর উপসর্গের সৃষ্টি করে। এর মধ্যে গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা অন্যতম একটি সাধারণ সমস্যা। মাথা ঘোরা অনেক সময় সামান্য কারণে হতে পারে, আবার অনেক সময় এটি গুরুতর সমস্যারও ইঙ্গিত দিতে পারে। তাই বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রতিটি গর্ভবতী মা এবং তার পরিবারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা কখন বেশি হয়?-
গর্ভাবস্থার প্রথম দিক থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত মাথা ঘোরা হতে পারে। তবে এটি সাধারণত বেশি হয় প্রথম তিন মাস (প্রথম ট্রাইমেস্টার) এবং শেষ তিন মাসে (তৃতীয় ট্রাইমেস্টার)।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা হওয়ার প্রধান কারণ-
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন শারীরিক ও হরমোনজনিত কারণ রয়েছে। নিচে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো তুলে ধরা হলো:
- হরমোন পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় হরমোনের তারতম্যের কারণে রক্তনালীগুলো শিথিল হয়। ফলে রক্তচাপ কমে গিয়ে মাথা ঘোরার অনুভূতি হতে পারে। - রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি
প্রেগন্যান্সির সময় শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শরীরের সাথে সামঞ্জস্য আনতে গিয়ে অনেক সময় মাথা ঘোরা দেখা দেয়। - লো ব্লাড প্রেশার
অনেক নারীর গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলে মাথা ঝিমঝিম বা ঘুরতে পারে। - লো ব্লাড সুগার (Hypoglycemia)
দীর্ঘক্ষণ না খাওয়া বা বেশি পরিশ্রম করলে শরীরে শর্করার মাত্রা কমে যায়, যা মাথা ঘোরার কারণ হতে পারে। - অ্যানিমিয়া (রক্তাল্পতা)
গর্ভবতী নারীর শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, ফলে রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং মাথা ঘোরা দেখা দেয়। - ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা)
পর্যাপ্ত পানি না খেলে বা বমির কারণে শরীরে পানির অভাব দেখা দিলে মাথা ঘোরা হতে পারে। - ঘুমের অভাব ও ক্লান্তি
পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিলে এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে শরীর দুর্বল হয়ে মাথা ঘোরা শুরু হয়। - শুয়ে থাকার ভঙ্গি
শেষের দিকের গর্ভাবস্থায় পিঠের ওপর সোজা হয়ে শোয়ার কারণে গর্ভাশয় বড় হয়ে প্রধান রক্তনালীতে চাপ ফেলে, যার ফলে মাথা ঘোরা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরার ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি-
যদিও মাথা ঘোরা সবসময় গুরুতর নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি বড় সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে:
- প্রচণ্ড মাথা ঘোরা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- মাথা ঘোরার সাথে বুক ধড়ফড় বা শ্বাসকষ্ট হওয়া
- হাত-পা অসাড় হয়ে যাওয়া
- ঝাপসা দেখা বা চোখে অন্ধকার নামা
- হঠাৎ পড়ে যাওয়া বা ভারসাম্য হারানো
এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা প্রতিরোধে করণীয়-
- ছোট ছোট খাবার খান
দীর্ঘসময় খালি পেটে না থেকে দিনে কয়েকবার অল্প অল্প করে খাবার খেতে হবে। - পানিশূন্যতা এড়ান
পর্যাপ্ত পানি, ডাবের পানি বা তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। - আয়রন ও ফলিক এসিড গ্রহণ করুন
চিকিৎসকের পরামর্শে আয়রন ও ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট খাওয়া জরুরি। - ধীরে ধীরে উঠুন
হঠাৎ দাঁড়িয়ে না গিয়ে ধীরে ধীরে উঠতে হবে, এতে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া এড়ানো যায়। - আরামদায়ক পোশাক পরুন
আঁটসাঁট পোশাক এড়িয়ে আরামদায়ক ঢিলেঢালা পোশাক ব্যবহার করুন। - যথেষ্ট বিশ্রাম নিন
দিনে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং রাতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। - শোয়ার ভঙ্গি পরিবর্তন করুন
গর্ভাবস্থার শেষ দিকে চিত হয়ে না শুয়ে পাশে কাত হয়ে শোয়া উচিত। - সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন
শাকসবজি, ফলমূল, প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেলে রক্তস্বল্পতা ও দুর্বলতা কমে।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরার ঘরোয়া প্রতিকার-
- লেবু পানি বা গ্লুকোজ খেলে তাৎক্ষণিক আরাম পাওয়া যায়।
- খেজুর বা কলা খেলে শরীরে শক্তি যোগায়।
- পুদিনা বা আদা চা হালকা মাথা ঘোরার ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?-
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা স্বাভাবিক হলেও কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো জরুরি। যেমন:
- ঘন ঘন মাথা ঘোরা
- রক্তচাপ খুব বেশি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
- তীব্র মাথাব্যথা
- ঝাপসা দেখা
- শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা
এগুলো প্রি-এক্লাম্পসিয়া, অ্যানিমিয়া বা অন্যান্য জটিল রোগের লক্ষণ হতে পারে।
উপসংহার-
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা একটি সাধারণ বিষয় হলেও এটি অবহেলা করা উচিত নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পানি পান এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এই সমস্যাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে মাথা ঘোরা যদি ঘন ঘন হয় বা এর সাথে অন্য জটিল উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর-
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা কি স্বাভাবিক?
উত্তর: হ্যাঁ, গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তন ও শারীরিক অবস্থার কারণে মাথা ঘোরা স্বাভাবিক হতে পারে। তবে এটি ঘন ঘন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় মাথা ঘোরা হলে কি শিশুর ক্ষতি হয়?
উত্তর: সাধারণ মাথা ঘোরা শিশুর ক্ষতি করে না। কিন্তু যদি এটি গুরুতর হয় বা অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়, তবে শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: মাথা ঘোরা কমানোর জন্য কী ধরনের খাবার খাওয়া উচিত?
উত্তর: আয়রনসমৃদ্ধ খাবার (যেমন কলিজা, ডাল, পালংশাক), শর্করা জাতীয় খাবার, ফলমূল ও প্রচুর পানি খাওয়া উচিত।
প্রশ্ন ৪: প্রেগন্যান্সিতে মাথা ঘোরা হলে ঘরোয়া উপায় কী হতে পারে?
উত্তর: লেবু পানি, ডাবের পানি, খেজুর, কলা বা গ্লুকোজ খেলে দ্রুত আরাম পাওয়া যায়।
প্রশ্ন ৫: কোন মাসে মাথা ঘোরা বেশি হয়?
উত্তর: সাধারণত প্রথম ও শেষ ট্রাইমেস্টারে মাথা ঘোরা বেশি দেখা যায়।