প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন: নবজাতকের সঠিক পরিচর্যা ও করণীয়

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন: ভূমিকা-

গর্ভাবস্থা পূর্ণ মেয়াদে সাধারণত ৩৭ থেকে ৪০ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু অনেক সময় নানা কারণে ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই শিশুর জন্ম হয়, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় প্রি-ম্যাচিওর বেবি বা অপরিণত শিশু। এ ধরনের শিশুর জন্ম হলে তাকে স্বাভাবিক নবজাতকের তুলনায় বেশি যত্ন নিতে হয়। কারণ প্রি-ম্যাচিওর শিশুর শরীর পুরোপুরি বিকশিত হয় না, যার ফলে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে।

এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত জানব প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন, করণীয়, ঝুঁকি, খাদ্যাভ্যাস ও চিকিৎসা পরামর্শ সম্পর্কে।

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চা কাকে বলে?-

যদি কোনো শিশু ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম নেয়, তবে তাকে প্রি-ম্যাচিওর বা অপরিণত শিশু বলা হয়। অনেক সময় এই শিশুর ওজন কম থাকে, ফুসফুস ও পরিপাকতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হয় না, ফলে অতিরিক্ত পরিচর্যা দরকার হয়।

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার সাধারণ বৈশিষ্ট্য-

  • জন্মের সময় ওজন ২.৫ কেজির কম
  • শরীরের ত্বক পাতলা ও লালচে
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • দুধ খাওয়ার ক্ষমতা কম
  • শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা
  • ঘন ঘন সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া

কেন প্রি-ম্যাচিওর শিশু জন্মায়?-

১. মায়ের শারীরিক সমস্যা – উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা ইত্যাদি।

২. একাধিক বাচ্চা বহন করা – যমজ বা ট্রিপলেট হলে সময়ের আগেই জন্ম হয়।

৩. সংক্রমণ – গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে সংক্রমণ হলে।

৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন

৫. অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুর্ঘটনা

৬. জরায়ুর সমস্যা – জরায়ু ছোট বা জটিলতা থাকলে।

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার ঝুঁকি-

  • শ্বাসকষ্ট (Respiratory Distress Syndrome)
  • সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি
  • ওজন না বাড়া
  • ব্রেইন হেমোরেজ
  • খাওয়ায় অসুবিধা
  • দীর্ঘমেয়াদে শেখার সমস্যা বা বিকাশে বিলম্ব

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন কিভাবে করবেন?-

১. নবজাতক আইসিইউ (NICU) কেয়ার
প্রি-ম্যাচিওর শিশু জন্মের পর অনেক সময় NICU তে বিশেষ চিকিৎসা নিতে হয়। এখানে শিশুকে ইনকিউবেটরে রেখে তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হয়।

২. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
প্রি-ম্যাচিওর শিশু নিজে থেকে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই তাকে সবসময় উষ্ণ রাখতে হবে। কাংগারু কেয়ার (মায়ের বুকে শিশুকে চামড়ার সাথে চামড়া লাগিয়ে রাখা) খুবই কার্যকর।

৩. মায়ের দুধ খাওয়ানো
মায়ের দুধই প্রি-ম্যাচিওর শিশুর জন্য সেরা খাদ্য। তবে অনেক সময় শিশুর চোষার ক্ষমতা কম থাকে। সে ক্ষেত্রে সিরিঞ্জ, কাপ বা টিউবের মাধ্যমে মায়ের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

৪. সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা

  • শিশুকে ধরার আগে হাত ভালোভাবে ধুতে হবে।
  • ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।
  • অসুস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে।

৫. নিয়মিত ডাক্তার চেকআপ
প্রি-ম্যাচিওর শিশুদের নিয়মিত ওজন, উচ্চতা, চোখ, কান ও স্নায়ুর পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।

৬. ভ্যাকসিন
অপরিণত শিশুদেরও সময়মতো টিকা দেওয়া জরুরি, তবে কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার বয়স ও ওজন অনুযায়ী সময় নির্ধারণ করেন।

৭. খাদ্যাভ্যাস

  • প্রথম ৬ মাস শুধু মায়ের দুধ
  • এরপর ধীরে ধীরে সলিড খাবার
  • আয়রন ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট ডাক্তার পরামর্শে

৮. শিশুর বিকাশ পর্যবেক্ষণ
প্রি-ম্যাচিওর শিশুদের অনেক সময় বিকাশে দেরি হয়। তাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি।

প্রি-ম্যাচিওর শিশুর মানসিক যত্ন-

শিশুর পাশাপাশি মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মা প্রি-ম্যাচিওর সন্তানের জন্মে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই পরিবার ও চিকিৎসকের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্নে পরিবারের ভূমিকা-

  • মা-বাবার ধৈর্য ও ভালোবাসা শিশুর বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
  • বাবা-মাকে শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা ও যত্ন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
  • পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও সঠিকভাবে শিশুর যত্ন নেওয়ার কৌশল জানা প্রয়োজন।

উপসংহার-

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় এবং এর জন্য বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। নবজাতককে উষ্ণ রাখা, মায়ের দুধ খাওয়ানো, সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই শিশুর সুস্থতার মূল চাবিকাঠি। পরিবার, চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞদের সম্মিলিত সহযোগিতা একটি প্রি-ম্যাচিওর শিশুকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের পথে এগিয়ে নিতে পারে।

প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চার যত্ন সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর-

প্রশ্ন ১: প্রি-ম্যাচিওর শিশুকে কিভাবে উষ্ণ রাখা যায়?
উত্তর: শিশুকে কাংগারু কেয়ার দেওয়া, উষ্ণ কাপড় পরানো, ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

প্রশ্ন ২: প্রি-ম্যাচিওর শিশু কি মায়ের দুধ খেতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে চোষার শক্তি কম থাকলে কাপ, সিরিঞ্জ বা টিউব ব্যবহার করে মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত।

প্রশ্ন ৩: প্রি-ম্যাচিওর শিশুর টিকা কখন দেওয়া হয়?
উত্তর: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে টিকা দেওয়া হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে ওজন ও বয়স অনুযায়ী ডাক্তার সময় পরিবর্তন করতে পারেন।

প্রশ্ন ৪: প্রি-ম্যাচিওর শিশু কি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ প্রি-ম্যাচিওর শিশু সুস্থভাবে বড় হয়। তবে কিছু শিশুর বিকাশে দেরি হতে পারে।

প্রশ্ন ৫: প্রি-ম্যাচিওর শিশুর যত্নে মায়ের করণীয় কী?
উত্তর: নিয়মিত মায়ের দুধ খাওয়ানো, কাংগারু কেয়ার দেওয়া, শিশুকে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখা এবং ডাক্তারকে নিয়মিত দেখানো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top